ঢাকা, ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ৫ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৮৮

আলোকবর্তিকার চিরবিদায়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:০৭ ১৫ মে ২০২০  

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

 

স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আল মারকাজুল ইসলাম। কবরস্থ করার আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।

 

রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) বৃহস্পতিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান। তাাঁর মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। একজন আলোকবর্তিকা এবং অভিভাবকের চিরবিদায় বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনরা। 

 

মৃত্যুর আগে ও পরে তার শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়।

 

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মরদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর জানা গেছে, তিনি করোনাভাইরাস পজিটিভ ছিলেন।

 

বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে আনিসুজ্জামানের ছোট ভাই মো. আক্তারুজ্জামান করোনা আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

 

ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, ভাষা সংগ্রামী, মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, সংবিধানের অনুবাদক, দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রবর্তী মানুষ।

 

তিনি ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। 


তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। 

 

১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএ-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’ বৃত্তি লাভ করেন।


সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

 

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। শিক্ষাজীবনের প্রথমভাগ তার সেখানেই কাটে।

 

দেশভাগের সময় তিনি কলকাতার এক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এরপর আরও অনেকের মত আনিসুজ্জামানদের পরিবারও চলে আসে এপারে।

 

ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করা আনিসুজ্জামান কৈশোরেই জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রথম যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল, তা লেখার ভার পড়েছিল তার ওপর।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আনিসুজ্জামান।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ১৯৬৫ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি পান। সেখানে তার অভিসন্ধর্ভের বিষয় ছিল 'উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল'।

 

পরে ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন ।

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আনিসুজ্জামান চলে যান ভারতে। সেখানে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।

 

১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন আনিসুজ্জামান। সেখানে দেড় যুগ শিক্ষকতা করে ২০০৩ সালে অবসর নেন। দুই বছরের মাথায় আবার তাকে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা বিভাগে ফিরিয়ে আনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই শিক্ষক।

 

দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, গবেষণা ও মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি একক ও যৌথভাবে অসংখ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভাষা ও শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা।

 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে; সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার। ভারত সরকার ২০১৪ সালে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে।

 

২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে।

 

শোকের ছায়া

 

মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডুকতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দীর্ঘ দিন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে ‘অভিভাবক’ হারানোর হতাশা জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় লেখক, অধ্যাপক ও সংস্কৃতি কর্মীরা।

 

প্রায় সাত দশক শিক্ষকতা ছাড়াও লেখালেখি, গবেষণা এবং সংকটকালে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৮৩ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার মারা যান।

 

জাতীয় জীবনে আনিসুজ্জামানের ভূমিকা স্মরণ করে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে শক্তি তার বড় স্তম্ভ ছিলেন তিনি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্বৈরাচারবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, কূপমণ্ডুকতাবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমরা তাকে অগ্রভাগে ভূমিকা দেখেছি।

 

“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধান প্রণয়নেও তিনি যুক্ত ছিলেন। সেই সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র , গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- এ থেকে যখন বহু পরিবর্তন হয়েছে দেশে, তা পুনঃস্থাপনার কাজেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ব্রতী ছিলেন।”

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিসুজ্জামানের সহকর্মী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি আমার ভাইকে হারালাম। এ শূন্যতা কোনো দিন পূরণ হবে না। যদিও তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন এবং তিনি আমার থেকে কিছু কনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-পাণ্ডিত্য ও গবেষণায় তিনি আমাদের থেকে অনেক উঁচুতে ছিলেন। আমাদের দেশের ভাষা ও সাহিত্য গবেষণায়, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে তার ভূমিকা, তার সাহসের তুলনা হয় না।”

 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “আমিও হসপিটালে আছি। আমাকে যখন প্রধানমন্ত্রী হসপিটালে পাঠিয়েছেন, তার পরের দিন আনিসুজ্জামান সাহেবকে পাঠানো হয়েছিল এখানে (সিএমএইচ)। উনি আজ চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই, পারিবারিকভাবেও আমরা শোকাহত। কারণ উনি আমাদের ৬৫ বছরের পারিবারিক বন্ধু। আমার বাবা উনাকে ছেলেবেলা থেকে দেখাশুনা করেছেন।”


মুনতাসীর মামুন বলেন, “আনিসুজ্জামানের মতো মানুষ শতকে একজন-দুজনই জন্মায়। বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। সবচেয়ে বড় বিষয় গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তি ও বৈষম্য নিরসনের জন্য যারা কাজ করেছেন, আনিসুজ্জামান তাদের অন্যতম ছিলেন। তিনি আমাদের সুধী সমাজ বলি, বুদ্ধিজীবী বলি, যেটাই বলি উনি শুধু আমাদের একজন শিক্ষকই নন, আমাদের একজন আশ্রয়স্থল ছিলেন। সমাজের মুরুব্বি বলে কিছু মানুষ থাকে যারা বিপদে এসে দাঁড়ান, আনিসুজ্জামান ছিলেন সে রকম একজন লোক।”

 

করোনাভাইরাসের কারণে অন্য সময়ের মতো প্রিয় মানুষটিকে বিদায় জানাতে না পারার আফসোস জানিয়ে তিনি বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৭০ বছর এদেশের সেবা করে গেলেন।কোনো দিন কিছুই চাননি তিনি। আমরা খুবই হতভাগ্য যে, গত এক মাসে আমাদের বোরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর, জামিলুর রেজা চৌধুরী, আজ আনিসুজ্জামান চলে গেলেন। কিন্তু এমন একটা সময়ে তারা চলে গেলেন যখন তাদেরকে আমরা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে পারছি না, যথাযোগ্য মর্যাদায় তাদেরকে বিদায় জানাতে পারলাম না!”

 

আনিসুজ্জামানের এক সময়ের ছাত্র ও পরবর্তীতে সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান বলেছেন, “বাঙালির মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিচিন্তার অনন্য বাতিঘর ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এ বেদনা ভাষাতীত, ব্যাখ্যাতীত…।

 

“অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যা কিছু রেখে গেছেন, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি তার থেকে অনেক লাভবান হবে। অনেক কাল ধরে আনিসুজ্জামান আমাদের পথ দেখাবে।”

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার আরেক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাঙালির মননশীলতার উজ্জ্বল এক প্রতিনিধি ছিলেন। আমাদের জাতির নানা ক্রান্তিকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই মানুষটির মৃত্যতে বাংলাদেশ অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ল। আমাদের মননশীলতার জগতটা অনেক দরিদ্র হয়ে গেল এবং এই দারিদ্র্য বহু বছরের সাধনাতেও আমরা পূরণ করতে পারব বলে আমি মনে করি না।”

 

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, “আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় যোদ্ধা। তার গবেষণা বাংলা গদ্য সম্পর্কে যেমন দিক উন্মোচন করেছে তেমনি তার অজস্র সম্পাদনাকর্ম আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।

“তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক, একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং একাডেমির ইতিহাসে সর্বাধিক কালপর্বের সভাপতি। বাংলা একাডেমি পরিবার তাকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ।”

 

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, “কী অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন স্যার! সাহিত্যে বিজ্ঞান সচেতনতা ও পাণ্ডিত্যে তার তুলনা মেলে না। স্যারের অনন্য গুণ ছিল, অনেক কথা তিনি খুব অল্পতে বলে দিতে পারতেন। অনেক যেখানে দশ পাতা লিখবেন, স্যার সেখানে দেড় পাতায় লিখে দিতেন। এত অল্পে সব কথা বলে দিতে পারতেন স্যার। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গন আজ সত্যি শূন্য হয়ে গেল।”

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক ও কবি কামাল চৌধুরী বলেন, “বাঙালির সৃজন ও মনন চর্চার এক অসাধারণ প্রতিভা ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে বটবৃক্ষের মতো। তার ছায়া সব সময় তরুণ প্রজন্মকে উজ্জ্বীবিত করেছে। তার কলম সদা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছে। আমি দেখেছি, মানুষকে কত সহজে কাছে টেনে নিতেন তিনি।

 

“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে তিনি আমাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, দিয়েছেন নানা পরামর্শ। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে তার যে অবস্থান, তা তরুণ প্রজন্মকে সব সময় উজ্জ্বীবিত করবে।”

 

এক শোকবার্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “জাতির যে কোনো সংকটকালে ও দুর্যোগময় মুহূর্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের আন্দোলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন সামনের সারির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। জাতির বাতিঘর হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হল, তা কখনই পূরণীয় নয়। দেশের শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”


“বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ড. কুদরাত-এ-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।”

 

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “এক কথায় বলব, আজ আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের জাতির বিবেককে। বাতিঘরের মতো তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। জাতির সামনে যখনই কোনো সঙ্কট এসেছে, আমরা তার মতামত নিয়েছি। সেই মতামত ছিল আমাদের কাছে শিরোধার্য।”

 

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ-৭১ এর চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল  কে.এম. সফিউল্লাহ, ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সি আর দত্ত এবং মহাসচিব হারুন হাবীব শোকবার্তায় বলেন, “বরেণ্য জাতীয় অধ্যাপক ও কৃতী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যু বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।

 

“ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী সকল কর্মকাণ্ড এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন  সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় বিবেক, দুর্দিনের বাতিঘর। তিনি জাতিকে আলোকিত করেছেন।  শত সংকটেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।” 

 

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সংগঠনটির এক বার্তায় বলা হয়েছে, “১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের জন্য গঠিত গণআদালতের অন্যতম অভিযোগকারী ছিলেন তিনি। আমৃত্যু নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছেন।


“ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তিনি সংবিধানের অনুবাদক, দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রবর্তী মানুষ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে আমাদের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং সর্বোপরি জাতীয় জীবনে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবে না।”

 

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ছায়ানট বলেছে, “বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের প্রাণিত করেছে। তিনি ছিলেন ছায়ানটের শুভান্যুধায়ী ও বিশেষ বন্ধু। দেশ ও সমাজের প্রতি তার অবদান মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।”

বাংলাদেশ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর