ঢাকা, ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৯৯৭

বাস-ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয়

ঈদযাত্রায় পথে পথে ভোগান্তি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৯:৩৭ ১০ আগস্ট ২০১৯  

ঈদ আনন্দ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে রাস্তার শত দুর্ভোগ, উটকো ঝামেলা আর বাধাকে উপেক্ষা করছেন ঢাকাছাড়া গ্রামমুখী লাখো মানুষ। সড়ক, রেল কিংবা নৌপথ – সবক্ষেত্রেই পড়তে হচ্ছে শিডিউল বিপর্যয়ের কবলে।  
পবিত্র ঈদুল আজহার বাকি মাত্র একদিন। ঈদ আনন্দে শামিল হতে নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ। এরই মধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন লাখো মানুষ। এখনও রাস্তায় অনেকে। ঈদে ঘরমুখী বাড়তি যাত্রী ও গাড়ির চাপে সারাদেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ধীর গতিতে যানবাহন চলছে। কোথাও কোথাও উড়াল সেতুর কারণে নির্বিঘ্নেই চলছে যানবাহন। ফলে দুর্ভোগ আর স্বস্তি মিলিয়ে চলছে এবারের ঈদযাত্রা।

ইট-পাথর আর কংক্রিটের শহর ছেড়ে নাড়ির টানে গ্রামে ফিরছে রাজধানীবাসী। ঈদের আনন্দ প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে গিয়ে পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। টিকিটপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঘরে ফেরা মানুষদের। শিডিউল বিপর্যয়, যাত্রীর অতিরিক্ত চাপ, আসন না পাওয়ার ভোগান্তি মেনে নিয়েই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেকড়ের টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ।

শুক্রবার বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়ায় ঘরে ফেরা মানুষ ঈদযাত্রায় চরম ভোগান্তিতে পড়ে। শুক্রবার বেলা পৌনে ২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল চলাচল শুরু হয়। সেই প্রভাব ওই রুট ব্যবহার করা সব ট্রেনে পড়ে। যার ফলে প্রতিটি ট্রেনই বিলম্বে যাতায়াত করছে। শনিবারের পরিস্থিতিও যথেষ্ট পীড়াদায়ক। 

ঈদযাত্রার চতুর্থ দিনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলো দেরিতে ছাড়ছে। এসব ট্রেনের কোনোটি ৬, কোনোটি ৮ এবং কোনোটি ১০ ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ছে। এতে চরম ভোগান্তি আর সীমাহীন বিড়াম্বনায় পড়েছে ঘরমুখো মানুষ।


কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক বলেন, গতকাল টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ কারণে দীর্ঘ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় সব ট্রেনের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। যে কারণে ট্রেনের শিডিউল ঠিক নেই।

প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ রাজধানী ঢাকা ছাড়ছে। শনিবারেও যাত্রী ও যানবাহনের চাপ রয়েছে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌ রুটে। বর্তমানে এ নৌ-রুটে ছোট-বড় ১৭টি ফেরি রয়েছে যানবাহন ও যাত্রী পারাপারের জন্য। পাশাপাশি যাত্রী পারাপারের জন্য রয়েছে ৮৮টি লঞ্চ, সাড়ে ৪শ স্পিডবোট ও ট্রলার।

শনিবার ভোর থেকে শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় যাত্রীদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের নিরাপত্তায় শিমুলিয়া ঘাটে পাঁচ শতাধিক পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত রয়েছেন।

বিআইডব্লিউটিএ’র সহকারি পরিচালক (মাওয়া) শাহাদাত হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন বৈরী আবহাওয়ার কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় শুক্রবার থেকে যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। তবে যাত্রী ও যানবাহন নির্বিঘ্নে পারাপারে আমাদের সার্বাধিক ব্যবস্থা সচল রয়েছে। 

মুন্সীগঞ্জের সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার (সিরাজদিখান সার্কেল) মো. রাজিবুল ইসলাম জানান, ঘাটে সকালে যাত্রী চাপ ছিল তবে এখন কমতে শুরু করেছে। ফেরিঘাট, লঞ্চ ঘাট ও সিবোট ঘাটে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। বাসে ভাড়া বেশি নেওয়াসহ কোন প্রকার অনিয়মের অভিযোগ আমাদের কাছে এখনো আসেনি। তবে কোন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পেলেই সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ রুটে যানবাহনের বাড়তি চাপে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ঘরমুখো হাজারো মানুষ। ফেরিঘাট থেকে টেপড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় যাত্রীদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। এ এলাকায় যানবাহনগুলো এলোমেলোভাবে চলাচল করায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

শনিবার সকাল থেকেই পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি ও লঞ্চে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। যানজটের কারণে প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকা পায়ে হেঁটে ঘাটে পৌঁছেছেন অনেক যাত্রী। যানজট ও ভোগান্তির জন্য ঘাট ব্যবস্থপনাকে দায়ী করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, ঘাটে বর্তমানে শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই।

ঘাটে কর্তব্যরত মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিবালয় সার্কেল) মো. মাহবুবুর রহমান জানান, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌ-রুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় অনেক গাড়ি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুট ব্যবহার করছে। এ কারণেই যানবাহনের বাড়তি চাপ রয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি যানবাহন রাস্তায় বিকল হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তবে যাত্রী পারাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দুপুরের পর থেকে যানবাহন ও ঘরে ফেরা মানুষের চাপ কমতে পারে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

চার লেনের সড়ক হয়েছে, হয়েছে উড়াল সেতু। প্রতিবারই সড়কে যানজট হবে না বলে ঘোষণা দেয়া হলেও সড়কে চিরচেনা সেচিত্র বদলায়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে।

সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের সড়কে কখনও দীর্ঘ যানজট, কখনও বা ধীর গতির কারণে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণবঙ্গের বাসের সিডিউলে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছে। কল্যাণপুর বাস টার্মিনালের উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের বাস কাউন্টারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৮-১০ ঘণ্টা করে দেরিতে ছাড়ছে প্রত্যেকটি পরিবহনের বাস। সকালের বাস এখনও টাঙ্গাইল কিংবা সিরাজগঞ্জ পৌঁছেনি। এমনকি রাতের বাস গন্তব্যে পৌঁছলেও ফেরার সুযোগ এখনও মেলেনি।

কল্যাণপুরের দেশ ট্রাভেলস, ন্যাশনাল, সালমা, শ্যামলী, এসআর, হানিফ, আল হামরা, আগমনী বাস কাউন্টারগুলোতে দেখা যায় যাত্রীতে ঠাসা। ব্যাগ লাগেজ নিয়ে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় শিশু, মহিলা, বৃদ্ধসহ সব বয়সী যাত্রীরা।

একটি করে বাস আসলেই উৎসুক যাত্রীরা দৌড়ে যাচ্ছেন কাউন্টারে। অনেকের সিডিউল না মেলায় মন খারাপ করে ফিরে আসছেন যাত্রী ছাউনিতে।

রাজশাহী-চাঁপাই রুটের দেশ ট্রাভেলসের কল্যাণপুর কাউন্টারের ইনচার্জ তৌহিদ বলেন, গতকাল রাত ১১টার গাড়ি ছাড়তে হয়েছে রাত ২টায়। রাতের ৪টি গাড়ি এখনও রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছেনি। সকালে গেছে ৮টি বাস। সেগুলো এখনও সিরাজগঞ্জ ফুড ভিলেজ এলাকা অতিক্রম করতে পারেনি। গাড়ি যেসব ছেড়েছি সেগুলো না ফিরলে আজ রাতের বাস তো ছাড়া সম্ভব না। যে কারণে পরিস্থিতি বুঝে আজ রাতের সিডিউল কিছু বাসের যাত্রীকে সকালে আসতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ আজ রাতে ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।


শুক্রবারের তুলনায় শনিবার গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মহাসড়কে ট্রাকসহ অন্যান্য গাড়ির চাপ কমলেও বেড়েছে বাসের চাপ। কিন্তু এখনও মহাসড়কের কোনো অংশে যানজট নেই। নেত্রকোনার এক যাত্রী বলেন, ভয়ে ছিলাম, ঠিক মতো পৌঁছাতে পারব কি-না? ঢাকা থেকে বের হওয়ার পর টঙ্গী, স্টেশন রোড, মিল গেট, চেরাগ আলী, কলেজ গেট, হোসেন মার্কেট, গাজীপুরা, তারগাছ, বড়বাড়ি, বোর্ড বাজার, হারিকেন ফ্যাক্টরি ও মালেকের বাড়িতে থেমে থেমে যানজট হয়েছে। তবে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। এ কারণে এ রুটে দুর্ভোগ কম হয়েছে। 
ইসলাম পরিবহনের বাস চালক সোহেল রানা জানান, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার সড়কে জুড়ে চলছে বিআরটি প্রজেক্টের কাজ। ওই অংশের মহাসড়ক খানাখন্দে ভরে গেছে। এতে দ্রুতগতির গাড়িগুলো ধীরে ধীরে চলছে। লোকাল বাসগুলো মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোয় একটু যানজট হয়েছে।

মাওনা হাইওয়ে থানার এসআই সুজন কুমার পণ্ডিত জানান, ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে হাইওয়ে থানা পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশও কাজ করছে। মহাসড়কের জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কোনোভাবে কোনো অবস্থাতেই মহাসড়কে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না।

সালনা হাইওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ একেএম কাওসার জানান, রাজেন্দ্রপুর থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত কোনো অংশে যানজটের লেশমাত্র নেই। যানজট ঠেকাতে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ মোতায়েন ও টহল পুলিশ রাখা হয়েছে।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বঙ্গবন্ধু সেতুর টাঙ্গাইল অংশে তীব্র যানজট। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে করটিয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। সেতু পার হওয়ার পর উত্তরবঙ্গের দিকে গাড়ি এগোতে না পারায় এ যানজটের সৃষ্টি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খানা-খন্দ আর বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জে ওই এলাকার গাড়ির চাপ বেশি থাকায় এ জট দেখা দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ঈদে ঘরমুখী মানুষ।

ঘরে ফেরা মানুষের চাপ থাকলেও এখন পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে কোথাও তীব্র যানজট দেখা যায়নি। শুক্রবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা উড়ালসড়ক খুলে দেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতায় এ উড়ালসড়ক খুলে দেয়ার পর থেকে সড়কের ওপর যানবাহনের তেমন চাপ দেখা যায়নি। ফলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গাড়িগুলো যানজট ছাড়াই ভুলতা অংশ পার হতে পারছে।

গত ঈদুল ফিতরে কাঁচপুর দ্বিতীয় সেতু, মেঘনা দ্বিতীয় সেতু ও মেঘনা গোমতী দ্বিতীয় সেতু খুলে দেওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল অনেক নির্বিঘ্ন এখন।