ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪ || ৭ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৮৫২

ঈদ আনন্দ: সেকাল-একাল

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:০৫ ৪ জুন ২০১৯  

 ঈদ মানে খুশি। জাতি-ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে সবাই একটি বিশেষ দিনকে খুশি বা ঈদ হিসেবে ব্যবহার করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের খুশির বড় ঈদ দুটি। রমজানের রোজা পালনের পর যে খুশি উদ্যাপন করা হয়, সেটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর। এ ঈদ মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বড়। আরেকটি হচ্ছে হজের সময় পশু কোরবানির ঈদ।
রমজানের চাঁদ শেষে যে চাঁদ পশ্চিমাকাশে উদিত হয় সেটি খুশির ঈদ। এ ঈদকে ঘিরে আনন্দ আর উল্লাসের জন্য মুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। ঘরে ঘরে, পাড়া-মহল্লা ও সমাজে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশাসন জনগণের ধর্মীয় আবেগ ও উল্লাসকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও এখানে সব ধর্মের মানুষকে সমান সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়। রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সব ধর্ম-গোত্রের মানুষের সমান সুযোগ প্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সব ধর্মের সব আয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটর করা হয়। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হলেও এ দেশ উদারপন্থি। এখানে সুন্নি, খারেজি, রাফেজি যত গ্রুপই থাকুক না কেন, সবাই তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও স্বাধীনভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না। বাংলাদেশের মানুষ যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, সবাই আনন্দের সঙ্গে নির্দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। বাংলাদেশ এ কারণে সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধার দেশ। বিশ্বের খুব কম দেশে মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান উদ্যাপনের সুযোগ-সুবিধা সীমিতভাবে দেখা যায়। বাংলাদেশের মুসলমানরা অত্যন্ত উদার ও শান্তিপ্রিয়। তারা অন্য ধর্মের প্রতি সর্বদা সুদৃষ্টি দিয়ে থাকে। অপরাপর ধর্ম পালনকারীরা নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে এ দেশে বাস করছে।
কথা ছিল ঈদ বা খুশি উদ্যাপন নিয়ে। এ দেশে যে কোনো ধর্মের ঈদ বা খুশির দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাই একে অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে চলেন। স্বাধীনতার পর হতে আমরা এদেশের সব ঈদ, খুশি এভাবেই দেখে আসছি। বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সব অনুষ্ঠানে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। হিংসা-বিদ্বেষের স্থান নেই এখানে। কেউ কাউকে ধর্ম-কর্মে বাধা সৃষ্টি করেন না। একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। মুসলমানদের ধর্মীয় খুশির সময় অন্য ধর্মের অনুসারীদের আসা-যাওয়া দেখা যায়। অন্য ধর্মের অনুষ্ঠান ও খুশিতে মুসলিমরাও অংশ নেন। আপ্যায়নে একে অপরের অতিথি হন। সাহায্যের হাত বাড়ান একে অপরের প্রতি। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ ও চরিত্র সবার মধ্যে দেখা যায়।
আজকালের মতো অতীতে এত ধনী ও অর্থবিত্তশালী মানুষ ছিল না। খেটে খাওয়া শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের গভীর মায়া-মমতা আর ভালোবাসা দেখা যেত। একে অপরের সুখে-দুঃখে ধর্মের পর্দা ছেদ করে এগিয়ে যেত। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। এক ধর্ম আরেক ধর্ম-গোত্রকে বাঁকা চোখে দেখত না। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজকের দিনের আনন্দ কিছুটা ম্লান মনে হয়। বর্তমানে মুসলমানদের খুশি যেন কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। কথা ছিল এক মুসলমান অপর ভাইকে খুশি উদ্যাপনে সাহায্য করবে। যাদের অট্টালিকা, অর্থ-সম্পদ পুঞ্জিভূত আছে, তারা আত্মকেন্দ্রিকভাবে ভোগবিলাসে মত্ত। তাদের সম্পদে দুর্বল ও দুস্থ মুসলমানদের অধিকার থাকলেও সে অধিকার থেকে বঞ্চিত এখনও অধিকারহারা মানুষ। মুসলমানদের সম্পদে অন্য মুসলমান ভাইয়ের অধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা সমাজে এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও দুস্থ, দরিদ্র অসংখ্য মানুষ মুসলিম পরিচয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ধনী দেশের স্বাবলম্বী মানুষগুলো তাদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না।
সত্যিকারভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি দরিদ্র ও অভাবী মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, তাহলে মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি দুস্থ মানুষ আহাজারি করত না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম এর জ্বলন্ত প্রমাণ। বর্তমানে নির্যাতিত-বিতাড়িত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম নর-নারীর প্রায় ১২ লাখের অধিক মানুষ বাংলাদেশে আশ্রিত। নিজ দেশে নির্যাতনের আঘাত সহ্য করতে না পেরে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশে মুসলিম দুনিয়ার যেভাবে এগিয়ে আসার দাবি ছিল, সে দাবি তাদের পক্ষে পূরণ হয়নি। এভাবে বিশ্বের নানা দেশে অসংখ্য নির্যাতিত মুসলিম নর-নারী উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও দেশের তাদের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের দাবি ছিল। কিন্তু সে বাণী আজ নীরবে-নিভৃতে আহাজারি করছে। তাই ঈদ-আনন্দ সেকাল আর একালের অনেক তফাৎ। অতীতে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, হিংসা আর বিদ্বেষ ছিল না। এখন তার বিপরীত। মানুষ সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কেউ খুশি, আনন্দে অথবা বিপদে এগিয়ে আসছে না।
বিজ্ঞান ও আধুনিকতায় পৃথিবী এগিয়ে গেলেও মানবতা ও মানবপ্রেম সেভাবে এগোচ্ছে না। তাই ঈদ-আনন্দ সেকাল আর একালের অনেক তফাৎ। এখন আর সেদিনের ভালোবাসা, মানুষে মানুষে হৃদ্যতা, সৌহার্দ্য চোখে পড়ে না। তবুও ফিরে আসুক সেদিনের মতো অহংকারমুক্ত ঈদ ও খুশি। সব মানুষের কাছে ঈদ হয়ে উঠুক সর্বজনীন খুশির।

ফ্রিল্যান্স লেখক

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর