ঢাকা, ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ৫ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১০৮৯

কালো মানেই ‘কালা ভুনা’ নয়

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:৫৬ ২৪ জুলাই ২০২১  

আপনার সামনে যখন গাঢ় খয়েরি রঙের প্রায় শুকনো করে রান্না করা মাংসের বাটিটা আসবে, তখন থেকেই আপনার মস্তিষ্কের নিউরোনে শুরু হবে এক অপার্থিব স্বাদ ক্ষরণ। আর যখন সরষের তেলে জারিত হওয়া এলাচ-দারুচিনি মাখা মাংসের গন্ধ নাকে লাগবে, নাকে লাগবে শুকনো মরিচের পোড়া পোড়া গন্ধ, তখন আপনার মনে হবে ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে।’ কিন্তু যখন মাংসের ওপরের গাঢ় খয়েরি রং ভেদ করে আপনার জিভ আঁশযুক্ত হালকা গোলাপি রঙের মাংসের স্বাদ পাবে, তখন সেটাকে কোনো উপমায় ধরতে পারবেন না।

 

হৃদয় নাচে, নইলে কি আর পুরান ঢাকার অলিগলির কিংবা নতুন ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের কালা ভুনার জন্য প্রতিদিন দীর্ঘ লাইন পড়ে? যারা মাংস ভালোবাসেন, বিশেষ করে গরুর মাংস, তাঁদের কাছে কালা ভুনা বা কালো ভুনা স্বর্গীয় স্বাদের লোভনীয় এক খাবারই বটে। কালো বলে কেউ তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি তো বটেই, কালো বলেই সবাই তাকে পাতে তুলে নিয়েছে। কে কতটা কালো করে রাঁধতে পারে, মাঝে মাঝে এখন তারও একটা ভুলভাল প্রতিযোগিতা দেখা যায়। ভুল! পুরো না হলেও আংশিক ভুল তো বটেই। ভুলচুক যাই হোক, আগে গল্পটা বলি।

 

গল্পটা বিরাট। কালা ভুনা মানে কষিয়ে কষিয়ে মাংস কালো করে ফেলার রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক গল্প নয়। কালা ভুনা মানে মমতা। কালা ভুনা মানে ভালোবাসার গল্প, জনপদের গল্প। কোরবানির পর যখন প্রচুর মাংস থাকে, তখন সেগুলোকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। এই ২০২১ সালে গ্রাম পর্যন্ত খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আজ থেকে বছর দশ আগেও যে পরিস্থিতি সেরকম ছিল না, সেটা আমরা জানি।

 

এবার আরও পেছনে যান—বিশ, ত্রিশ কিংবা পঞ্চাশ বছর। কী দেখবেন? একটি অযান্ত্রিক গ্রামীণ পরিবেশ, যেখানে ফ্রিজ তো দূরের কথা ইলেকট্রিসিটির খাম্বাও নেই। সে সময়ও মানুষ মাংসসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার সংরক্ষণ করত। খাবার সংরক্ষণ করার বিভিন্ন স্থানীয় উপায় ছিল সে সময়।

 

সেরকমই একটি পদ্ধতি হলো, অনেক মাংস এক সঙ্গে হাঁড়িতে জ্বাল দিয়ে রাখা। প্রতিদিন অল্প অল্প করে জ্বাল দিতে হবে। একটু হাড়সুদ্ধ মাংস বেশি করে রাখা হতো, যাতে জ্বাল দিয়ে নরম করে খাওয়া যায়। আমি বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি বিষয়টি নিয়ে। তাঁরা জানিয়েছেন, এখন সময়ের অভাবে এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে নিজেরা না করলেও, দাদি কিংবা নানি অথবা মায়ের হাতে বহু আগে খেয়েছেন এমন খাবার।

 

আরও যেটি জানা যায়, জ্বাল দেওয়া এই মাংস খাওয়া হতো তিন চার দিন পর থেকে। মাংসের হাঁড়ি থেকে মাংস তুলে তাকে আলাদাভাবে হালকা মসলা দিয়ে রান্না করা হতো। যেহেতু প্রতিদিন মাংসের হাঁড়িতে জ্বাল দেওয়া হতো, তাই সে হাঁড়ির মাংস নরম হয়ে ধীরে ধীরে কালচে রং ধারণ করত। কিন্তু মাংসের ভেতরটা থাকত গোলাপি আভাযুক্ত।

 

পরে যখন সেই মাংস কষিয়ে রান্না করা হতো, তখন তার ভেতরটা হতো গোলাপি রঙের জুসি আর বাইরের অংশ কষানোর ফলে কালো রং ধারণ করত। এটিই হলো কালা ভুনার আদি উৎস। পুরো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের খাবারের প্রচলন ছিল এক সময় এবং এখনো কোথাও কোথাও আছে। নিদেনপক্ষে কোনো কোনো পরিবারে এখনো সেটার চর্চা আছে কোরবানির সময়।

 

অঞ্চল হিসেবে চট্টগ্রামের কালা ভুনার খ্যাতি আছে বিশেষ। অনেকে কালা ভুনাকে চট্টগ্রামের খাবার বলে উল্লেখ করে থাকেন। চট্টগ্রামের হোরবাইন্নে ফুঁঅনা গোশত, ফুয়ানা গোশত, কওয়াবের গোশত, কোয়াবের গোশতকেই এখন কালা ভুনা বলা হয় তার মূল প্রক্রিয়াটিকে বাদ দিয়ে। চট্টগ্রামের বিশেষ খ্যাতি থাকলেও মাংস সংরক্ষণ করার এ পদ্ধতি অনেক প্রাচীন এবং এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই প্রচলিত। তবে রন্ধনপ্রণালি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম আছে। আছে মসলা প্রয়োগের ভিন্নতাও।

 

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রন্ধন প্রণালিটি কী?
হলুদ ছাড়া মাংস ৩–৪ দিন জ্বাল দেওয়ার পর ঝোল থেকে তুলে পেঁয়াজ বেরেস্তা করে মসলা কষিয়ে টালা মসলা দিয়ে ভুনা করাই হচ্ছে কালা ভুনা। টালা মানে, মাটির খোলায় হালকা গরম করে নেওয়া। এখন আপনি অন্য কিছুতেও মসলা হালকা ভেজে নিতে পারেন। তারপর কিছু গোটা আর কিছু গুঁড়ো করে মাংসে ব্যবহার করতে পারেন।

 

যেহেতু মাংস ৩–৪ দিন জ্বাল দেওয়া হয়, তাই এটি নরম থাকে। তারপর আবার কষিয়ে রান্না করলে তার বাইরের অংশ কালো বা গাঢ় খয়েরি একটা রং ধারণ করে। আর ভেতরটা গোলাপি থেকে যায়। এবার আপনি আপনার ইচ্ছেমতো রান্না করতে পারেন।

 

রেসিপি
গরুর মাংস বড় টুকরো করে চর্বিসহ হলুদ ছাড়া সব মসলা খুব অল্প করে দিয়ে কয়েকবার নেড়েচেড়ে নিতে হবে। তারপর তেলে পেঁয়াজ বেরেস্তা করে, আদা-রসুন-পেঁয়াজ বাটা, ধনে-জিরা-মরিচ গুঁড়ো দিয়ে মসলা কষিয়ে তার মধ্যে মাংসটা ঝোল ছাড়া কষাতে হয়। টালা মসলার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিন ওপরে, তাতে একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে।

 

টালা মসলা গুঁড়োতে থাকে গরম মসলা, মৌরি, রাঁধুনি, জায়ফল, জয়ত্রী, আস্ত ধনে, শুকনা মরিচ, গোল মরিচ। ঢিমে আঁচে অনেকক্ষণ ধরে পানি ছাড়া কষিয়ে নিন। তারপর আপনার পছন্দ মতো রং পেয়ে গেলেই নামিয়ে খেয়ে নিন। খাসির মাংস দিয়েও রান্না করা যায় এটি। আবার অনেকে বলেন, যেকোনো রেড মিট দিয়েই তৈরি করা যায় এই উপাদেয় খাবার।

সুমির রান্নাঘর বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর