ঢাকা, ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০
good-food
১৯২৮

ছুটি পায় না পুলিশ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:৫৮ ১২ আগস্ট ২০২১  

থানার দরজা কখনো বন্ধ হয় না। স্বাভাবিকভাবে পুলিশের সাপ্তাহিক ছুটি বলতে কিছু নেই। ঈদ, পূজা, পার্বণে যে ছুটি মেলে, তা-ও সবার ভাগ্যে জোটে না। বছরে দু-একবার ছুটি পেলেও শেষ পর্যন্ত তা ভোগ করা যায় না–এমন নজিরও আছে। বছরের পর বছর এভাবেই দায়িত্ব পালন করতে হয় পুলিশ সদস্যদের। তাঁদের এসব কষ্টের কথা কেউ জানে না।

 

ছুটি নিয়ে বাহিনীর সদস্যদের এই হতাশার কথা উঠে এসেছে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের একটি জরিপে। ছুটি নিয়ে কষ্ট আর হতাশা যে শুধু নিচের পদে, তা নয়। এএসপি, এসপি বা আরও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তাদের কাছ থেকেও এমন হতাশার কথা শোনা গেছে।

 

পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার এআইজি সোহেল রানা এ জন্য মূলত করোনা পরিস্থিতিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, মানুষের সেবায় পুলিশ নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। অনেকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ এভাবেই কাজ করে যাচ্ছে।

 

সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, কাজের চাপে তাঁরা যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন, সে কথা সবাই স্বীকার করেছেন। এই তো গত ঈদুল আজহার দিন সকালে নিজের রাইফেলের গুলিতে মেহেরপুরে পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম আত্মহত্যা করলেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা খাতুন নিজেও পুলিশ।

 

তিনি দাবি করেন, কর্মব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় তাঁর মধ্যে হতাশা ছিল। ছিল পারিবারিক জটিলতাও। আবার গত ১৫ জুলাই রাঙামাটিতে নিজের বন্দুকের গুলিতে পুলিশ সদস্য কাইয়ুম সরকার আত্মহত্যা করলেন। তিনি নানাবিধ পারিবারিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের বাসভবনে দায়িত্বরত এক পুলিশ কনস্টেবল ‘নিজের অস্ত্রের গুলিতে’ নিহত হলেন। মানসিক কোনো চাপ বা সমস্যা থেকে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে জানালেন পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির রমনা বিভাগের এক সহকারী পরিদর্শক বলেন, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলেও ছুটি মিলছে না। দরখাস্ত নিয়ে পিছে পিছে ঘুরতে হয়। এতে মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

 

‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার ও উন্নয়নে মাঠপর্যায়ের মতামত ২০২০’ শিরোনামে একটি জরিপ চালিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। রেঞ্জ, মেট্রোপলিটন, পার্বত্য অঞ্চল ও বিশেষায়িত ইউনিটের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদবির ৪৪১ জন পুলিশ সদস্য এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে একাধিক প্রশ্নের মধ্যে একটি ছিল: ছুটি পাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হন? এই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ১৮৪ জন ছুটি নিয়ে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আর ১৫২ জন বলেছেন, ছুটি নিতে চাইলে ঘুষ দিতে হয়। না হলে ছুটির দরখাস্ত ওইভাবেই পড়ে থাকে।

 

জরিপে অংশগ্রহণ করা পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, ছুটির কথা বললেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা খারাপ আচরণ করেন। নানা অজুহাতে ছুটির প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। দরখাস্ত হাতে নিয়ে ফেলে রাখেন। টাকা না দিলে ছুটি বন্ধ করে দেন।

 

গত ঈদুল আজহার তিন দিন আগে ছুটির দরখাস্ত হাতে নিয়ে পুলিশ সুপারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। করোনাকালে তাঁর ৮৫ বছর বয়সী মা শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। সংশয়ে আছেন কখন কী হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ছুটি মিলেছিল তাঁর। কিন্তু তাঁর মতো এমন অনেকে ছুটি না পেয়ে গুমরে কেঁদেছেন।

 

বগুড়া জেলা পুলিশের নন্দীগ্রাম সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রাজিউর রহমান বলেন, ‘পুলিশের চাকরিটাই এমন। জেনে বুঝেই এসেছি। চাইলেও ছুটি মেলে না। নেই কোনো সাপ্তাহিক ছুটিও।’

 

অনেক পুলিশ সদস্যের আক্ষেপ, সরকারি চাকরিতে অবসরে যাওয়ার সময় ন্যূনতম এক বছরের ছুটি জমা থাকতে হয়। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অবসর নেওয়ার আগে প্রায় সবারই অর্জিত ছুটি দেড় থেকে দুই বছরে গিয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত ছুটির বিনিময়ে তাঁরা কোনো সুবিধাও পান না।

 

সদস্যদের ছুটির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইউনিটপ্রধানরা মোট ফোর্সের ২০ শতাংশ সদস্যকে ছুটি দিতে পারি। কিন্তু করোনাকালে সব ছুটি বন্ধ আছে।’

 

ছুটি দিতে টাকা নেওয়া হয়–এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপির কমিশনার বলেন, মহানগর এলাকায় এই সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে প্রত্যন্ত থানা এলাকায় এটা হতে পারে।

 

পুলিশের ছুটি ও হতাশার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, অনেক সময় কাজের চাপ থাকে। কিছু বাধ্যবাধকতাও থাকে। সবকিছুই হয় জনগণের নিরাপত্তার কারণে। হয়তো সে কারণেই গণহারে ছুটি দেওয়ার সুযোগ কম। তাই বলে সপ্তাহে এক দিনও ছুটি পাবে না, তা হয় না।