ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১০১১

অথৈ পানির মাঝে অন্যজীবন

নৌকায় ঈদ জামাত !

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৯:২৩ ৫ জুন ২০১৯  

নৌকা কী হতে পারে ঈদগাহ মাঠ?  

ঠিক তাই। নৌকা দিয়েই সাজানো হয় ঈদগাহ মাঠ। আর নৌকাতেই হয় ঈদের নামাজ।

নিচে অথৈ পানি। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। সামনে-পেছনে শুধু নৌকা আর নৌকা। তাই নৌকাতেই হয় ঈদের নামাজ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দলে দলে মানুষ তাদের নৌকা নিয়ে হাজির হন ঈদের নামাজ পড়ার জন্য।

 

এলাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে আসা নৌকাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটিকে বেঁধে ফেলা হয়। যত বেশি মানুষ, তত বেশি নৌকা। কেবলামুখী হয়ে সারিবদ্ধ ওই নৌকার ওপরেই সম্পন্ন হয় ঈদের জামাত।

 

 

 

ইমাম সাহেবের নৌকাটি কেবল একটু সামনের দিকে বাড়ানো থাকে। আর বাকি নৌকাগুলো ওই নৌকার ঠিক পেছন দিয়ে ডানে-বামে সাজিয়ে তৈরি করা হয় নামাজ পড়ার জায়গা। নৌকার পাটাতনে বিছানো হয় জায়নামাজ। শুরু হয় ইমাম সাহেবের বয়ান। তারপর যথারীতি ঈদের নামাজ।

 

ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আজহা। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার চিনাধুকুড়িয়া গ্রামে সময়ের ফেরে কিংবা প্রকৃতির কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব বরণ করে পানি থৈ থৈ বিলে নৌকার ওপিই অনুষ্ঠিত হয় ঈদ নামাজের জামাত। শুধু এই গ্রামেই নয়, আশপাশের গ্রামগুলোতেও এই ধরনের ঈদ জামাত হয়।

 

চিনাধুকুড়িয়া গ্রামটির দক্ষিণে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। পাথারের ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতে। দক্ষিণে সাধক দরবেশ হজরত মুহম্মদ ওয়াজেদিয়া রহমতুল্লাহর মাজার শরিফ, সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়াজেদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ।

 

যে মাঠটি ভাগ হয়ে আরো দুটি নতুন মাঠ হয়েছে এ গ্রামে। একটি দক্ষিণে। আরেকটি গ্রামের পশ্চিমে করবস্থানের পাশে। মাদরাসাসংলগ্ন খেলার মাঠের সামনের এই ঈদগাহ মাঠটির ভূমি সমতল। গ্রীষ্মকালে ঈদের নামাজ এই মাঠেই পড়া হয়। কিন্তু পর্যায়ক্রমে ঈদ এগিয়ে বর্ষাকালে হলে মাঠটি বর্ষার পানিতে ডুবে যায়। ঈদের নামাজ পড়ার জন্য তখন মুসল্লিদের মসজিদে জায়গা সংকুলান হয় না। ফলে বর্ষায় ডুবে যাওয়া ঈদগাহ মাঠে, কিংবা খোলা প্রান্তরে খুঁটি গেঁড়ে একের পর এক নৌকা বেঁধে নামাজের জন্য জায়গা প্রস্তুত করা হয়।

 

 

 

প্রতিটি নৌকায় দু-তিনজন মুসল্লির একাধিক সারি থাকে। প্রতিটি নৌকার সারি মিলে হয় একটি কাতার। এভাবেই একটার পর একটা কাতার করে নামাজের জন্য দাঁড়ানো হয়। মাঝের একটি বড় নৌকা সামনে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে একটু আগানো থাকে। সেখানে দাঁড়ান ইমাম সাহেব। মাইকে ইমাম সাহেব নামাজ পড়ান এবং খুতবা পাঠ করেন। নামাজ পড়ে দোয়া ও কবর জিয়ারত শেষে যার যার গন্তব্যে ছুটে চলে নৌকা।

 

ঈদের দিন বিকেলে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় আনুষ্ঠানিক নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু এবং লাঠি খেলা প্রতিযোগিতা। সব খেলায় দুটি পক্ষ থাকে। বিবাহিত এবং অবিবাহিত। এসব খেলা শেষে পুরস্কার দেয়া হয়। পুরস্কারের মূল অর্থদাতা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসা জামাইরা।

 

যমুনা, করতোয়া, হুরাসাগর, পদ্মা ও চলনবিলের কিছু অংশ বেষ্টিত প্রত্যন্ত নিম্নাঞ্চল। শাহজাদপুর থানার পশ্চিমে প্রাচীন কৃষিপ্রধান ছোট্ট একটি গ্রাম চিনাধুকুড়িয়া। ‘চিনা’ নামক ফসল ভালো ফলত বলেই গ্রামটির এই নামকরণ। এই গ্রামে তিন হাজার বাড়ি রয়েছে। এই অঞ্চলে বর্ষার ছয় মাস থাকে পানি। তখন টইটুম্বুর পানিতে ভেসে থাকে গ্রামটি। রাতে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত গ্রামটি তখন বেশ অপরূপ লাগে। নদীবিধৌত পালিজাত পলির অববাহিকায় গড়ে ওঠা গ্রামটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা। উঁচু উঁচু বাড়ি। ৩৫ বছর আগে বিদ্যুৎ এসে আলোকিত করেছে গ্রামটি। শিক্ষার হার শতভাগ।

 

 

 

প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় জোয়ার-ভাটায় রাক্ষুসী যমুনা, বড়াল, হুরাসাগর, ইছামতি, ফুলঝোড়, করতোয়া ও কালিঞ্জা নদী সময় পেলেই দুই কূল প্লাবিত করে ভাসিয়ে দেয় মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। বন্যার ভাঙনের মুখের দুরন্ত শক্তি নিয়ে এখানকার মানুষ যেমন পারে সইতে, তেমনি পারে গড়তে।

 

অসীম সাহস আর ঐতিহ্য নিয়ে বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত হয়েছে এই এলাকার ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। আর বর্ষার সময় এখন এই সংস্কৃতিই যেন একটি অংশ হয়ে গেছে ঈদের নামাজ নৌকায় পড়ার।