ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
২৪৪৫

পক্ষী সমাচার-১

আজিজুস সামাদ ডন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:৪২ ৩ এপ্রিল ২০১৯  

আমার ভাতিজা ওলির কল্যাণে, ইতালির মিলান শহরের বিশাল এক চত্বরে আমার জীবনের সুন্দরতম মুহুর্ত সমুহের একটি কাটাইয়াছিলাম। সেই চত্বরে গম হাতে লইয়া দাঁড়াইবার পর শত শত কবুতর যখন আমাকে ঘিরিয়া ধরিলো, তখন মনে হইল আমি সন্ন্যাসী হইয়া গিয়াছি। কবুতরগুলি আমাদের জালালি কবুতরের মত দেখিতে। ভয়শুন্য চিত্তে তাহারা আমার হাতে-কাঁধে বসিয়া গম খাইতেছে। আমার ইচ্ছা হইতেছিল সারাটা দিন ঐখানেই কাটাইয়া দেই।

 

বাংলা ভাষায় লেখালেখি করি বলিয়া বাংলা ভাষায় যেই সমস্ত প্রবাদ, উপমা, বাগধারা আছে, সেই সমস্ত বিষয় লইয়া কিছুটা তো ভাবিই। আর যেইহেতু আমি নিজে সিলেট অঞ্চলের সন্তান, সেইহেতু সিলেটি কিছু প্রচলিত গল্পও জানিবার চেষ্টায় থাকি।

 

সেইদিন কিছু বাংলা প্রবাদ, বাগধারা লইয়া ভাবিতে বসিয়া হোঁচট খাইলাম।

‘ভাত ছিটাইলে কাকের অভাব হয় না’।

 

ইহা খারাপ কিছু কথা নহে। প্রবাদটির উৎপত্তি অবশ্যই আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান হইতেই উৎসরিত। যাহারা ভাত ছিটাইতেছে, তাহারা মনের আনন্দেই ছিটাইতেছে, কোকিল বা কবুতর বা অন্য কোন পক্ষী খাইতেছে কিনা উহা তাহাদের নিকট কোন বিষয় নহে, কাক তো নহেই। সুতরাং, উক্ত বচনে যাহারা ভাত ছিটাইতেছে তাহারা আমার বিবেচ্য বিষয় নহে। আমার সমস্যা দাঁড়াইলো "কাক" শব্দটির নিকট আসিয়া। প্রশ্ন আসিয়া দাঁড়াইলো, ভাত ছিটাইলে কোকিল, কবুতর, ঘুগু, টিয়াসহ সকল ধরনের পক্ষীই আসিবে, তাহাই স্বাভাবিক। যে পক্ষীগুলি আসিতেছে তাহারাও আসিতেছে তাহাদের অভ্যাসগত কারণে, অর্থাৎ, পক্ষীগুলি অভ্যস্ত ঐভাবে কুড়াইয়া পাওয়া জিনিস খাওয়াতেই, তাহা কাহারো পাকা ধান ক্ষেত্রের বারোটা বাজাইয়াই হউক অথবা যাহারা মনের আনন্দে ছিটাইতেছে তাহাদের নিকট হইতেই হউক।

 

কিন্ত প্রবাদটিতে শুধু কাকের কথা আসিলো কেন ?

 

ঐ প্রবাদ বাক্য বিশ্লেষণ করিবার জন্য আমার মনের আকুলবিকুলি বাসনা পরিলক্ষিত হইবার কারণে কিছু কথা না বলিয়া পারিতেছি না।

কাক একটি উচ্ছিষ্টভোগী অতি চালাক কিন্ত আবার অতি বোকা পক্ষী। বোকা কারণ, কাক লইয়া আরেকটি গল্প আছে, তাহারা চক্ষু বন্ধ করিয়া রাখিয়া মনে করে, সে নিজে যেহেতু কাহাকেও দেখিতেছে না, সুতরাং, অন্য কেহ তাহাকে দেখিতেছে না। এহেনো কাক, ভাত ছিটাইলে তো আসিবেই, ডাস্টবিনের ময়লা ছিটাইলেও আসিবে। যাহাদের ঘরে অতিরিক্ত ভাত আছে এবং সেই অতিরিক্ত ভাত ছিটাইবার যাহাদের ঔদ্ধত্য আছে, তাহাদের উদর কতটা পূর্ণতা পাইলে, তাহারা ঐ ভাত ছিটাইবার চিন্তা করিতে পারেন, উহা লইয়া গবেষণা চলিতেই পারে।

 

কাক সংক্রান্ত বিশ্লেষণের এইখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হইলো। এইবার কাক বিষয়ক কিছু আলোচনা করা যাইতে পারে।

 

কাককে খুব কমই দেখিয়াছি কাহারো ধান ক্ষেত্রের পাকা ধান খাইয়া ক্ষুধা যন্ত্রনা লাঘব করিতে। বরং কাককে ময়লা শ্রেণীর খাদ্যভোগী বলা যাইতে পারে। কাক কাহিনী লইয়া অনেক কথা আগেই হইয়া গিয়াছে। আমার মনে হইয়াছে, যেই কথনগুলো হইয়াছে, তাহা না বুঝিয়াই হইয়াছে, যেই কারণে কাকের বদলে কাউয়া শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে।

আমি বাংলা একাডেমী কর্ত্তৃক প্রকাশিত বাংলা অভিধানে যাইয়া "কাউয়া' শব্দের অর্থ খুঁজিয়া পাইলাম  = "শিশুদের অতি প্রিয় লাল রঙের বনফুল বিশেষ";  ঐ একই অভিধানে "কাউয়া" শব্দের দ্বিতীয় অর্থে আসিয়া তো সিলেটি হিসেবে গর্ব বোধ করিতে শুরু করিলাম; "শ্রীহট্টে প্রচলিত "কাউয়ালুলি"=তেলকুচা ফল"।

এই কাউয়ালুলি ফল লইয়া অনেক আগেই একবার বলিয়াছি, ইহা জংলী ফল, রাস্তার পাশে জন্মায়, দেখিতে দারুন কিন্ত বিষাক্ত; এইবার হইলোনি ভেজাল। তাহা হইলে "কাউয়া" কাহিনী লইয়া এতো যে কথা হইলো, উহা কি শিশুদের প্রিয় রঙের ফুল লইয়া হইল, নাকি বিষাক্ত অথচ দেখিতে সুন্দর ফল লইয়া হইল।

 

যাহাই হউক, কাক গুলি উচ্ছিষ্ট ভোগী জানিয়াও, যে বা যাহারা কাকগুলিকে খাওয়াইবার চেষ্টা করিয়াছেন, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়াছেন, কাকদিগকে খাওয়াইবার প্রচেষ্টা তাহাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না; বিষয়টি ছিল অনেকটা এইরকম, আমাদের আছে তাই ছিটাইতেছি, মজা দেখিতেছি। তাহাদের সেই মজা দেখিবার ইচ্ছার কারণে, কাকগুলির উৎপাতে অন্যদের যে প্রাণ ওষ্ঠাগত, উহা তাহাদের বুঝাইবে কে। ঐ ভাত ছিটানেওয়ালা মানুষদের উপলব্ধিতে হয়তো আসে নাই, এই কাকেরা যদি সেই ছিটানো ভাত না পাইতো, তাহা হইলে হয়তো ঐ কাকসমুহ সমাজের কিছু উপকারে আসিতো, ডাস্টবিনের মরা ইদুর হইতে শুরু করিয়া পরিবেশ দুষণের হাত হইতে সমাজকে রক্ষা করায় তাহারা ব্রতী হইতো।

 

আমি ব্যক্তিগতভাবে তীব্র প্রতিবাদ করিতে চাহিতেছি "ভাত ছিটাইলে কাকের অভাব হয় না" প্রবাদটির। যদি বলিতেই হয় তাহা হইলে বলা উচিৎ, "ভাত ছিটাইলে পক্ষীর অভাব হয় না"। তবে যেই অর্থে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হইয়া থাকে, তাহার বিষয়ে বাংলা ভাষায় আরো অনেক সুন্দর সুন্দর বাগধারা আছে, যেমন, "বসন্তের কোকিল"। প্রথমত, বসন্তের কোকিলেরা গ্রীষ্মে বা শীতে গান না শুনাইয়া ভাগিয়া যাইলেও, অন্তত বসন্তে তো কিছু সুমধুর সঙ্গীত শুনাইয়া যায় এবং সারাটা বছর অন্তত কাকের কর্কশ স্বরে জীবন অতিষ্ঠ হইয়া ওঠে না। আর দ্বিতীয় কারণটা তো আরও ভাল, কোকিল আর কাকের চিরন্তন শত্রুতার কারণে, কোকিল আসিলে কাক থাকিবে না।

দুইটি পক্ষীই সুবিধাবাদী তো।

 

যাহাই হউক, মান্না দে'র একটি গান বিশ্লেষণ করিয়া আমার এই বিপ্লবী ভাষা জ্ঞানের পরিসমাপ্তি টানিতে চাহিতেছি। গানটি হইলঃ

"হৃদয় আছে যার

সেই তো ভালবাসে"।

 

এই গানের সমস্যা হইল, মৃত মানুষেরও তো হৃদপিন্ড আছে। গানের ভুলটা আমার চোখে পরিবার পর হইতে আমি খুব চিন্তিত। একবার তো ভাবিয়াছিলাম গীতিকারকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া তাঁহার সহিত আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করিবো কিন্ত পর মুহুর্তে মনে হইল, এতো পুরাতন গানের গীতিকারকে খুঁজিয়া পাইতে হইলে আমাকে হয়তো ইহজাগতিক সম্পর্ক চুকাইয়া ফেলিতে হইবে। এই সামান্য কারণে উহা করিবার সাধ মনে জাগিলো না দেখিয়া নিজেই সমাধান খুঁজিতে বসিয়া গেলাম এবং সমাধান খুঁজিয়া পাইবার পর আর্কিমিডিসের মত ইউরেকা বলিয়া রাস্তায় উলঙ্গ দৌড়াইবার মত সমাধান হইয়াছে বলিয়া মনে না হইলেও, সমাধানটি আমার বেশ ভাল লাগিল। আমার আবিষ্কারটি হইল, গানের কথা গুলি হওয়া উচিৎ ছিল,

হৃদস্পন্দন আছে যার

সেই তো ভালবাসে।

 

আর আমার এই আবিষ্কার যদি সঠিক না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তো বিশাল ভেজাল, আমাকে আবার তত্ত্ব লইয়া ভাবিতে বসিতে হইবে। এই বিষয়ে তত্ত্বটা এমন বিশেষ কিছু যদিও নহে, সুতরাং, বসা যাইতেই পারে। খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে প্রাাণের উৎস কি? হৃদস্পন্দন বন্ধ হইবার পর কি ভালবাসাও থামিয়া যায়, নাকি ভালবাসা চিরন্তন। কবির ভাষায়,

"মানুষের শোকের আয়ু

বড়জোর এক বছর"।

 

এইটুকু শোকের মাতনের জন্যই কি ভালবাসা লইয়া এতো আয়োজন, এতো অশুদ্ধ অর্থ বহনকারী সঙ্গীত রচিত হইয়াছে। শব্দটি "আয়োজন" ব্যবহার করিলাম, কারণ, পৃথিবী চলিইতেছে ভালবাসার উপর, তাহা হউক নর-নারীর ভালবাসা, হউক বাৎসল্য, হউক ক্ষুধা নিবারক ভালবাসা (ক্ষুধা আবার দুই রকমের, লোভের ক্ষুধা আরেকটি উদরস্থ ক্ষুধা), হউক স্বাধীনতার জন্য ভালবাসা, হউক আদর্শের প্রতি ভালবাসা, হউক অর্থের বা ক্ষমতার অথবা ধর্মের প্রতি ভালবাসা। কিন্ত হৃদস্পন্দন থামিয়া যাইবার পর,

"মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর"।

আমার ভাষায় নহে, কবি সুভাষের ভাষায় কথাটি উল্লেখ করিলাম মাত্র।

 

লেখক : রাজনীতিক, বিশ্লেষক