ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১১৩১

মা থাকে না ওই গ্রামে

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৯:৪৭ ১২ মে ২০১৯  

কিশোরী এলি সুসিয়াবতী গত ছয় বছর ধরে মাকে দেখেনি। তাই তাকে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে গেলেই আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ে বলেন, মাকে খুব মিস করি, মাঝে মধ্যে খুব একলা আর বিষন্ন লাগে। মা-বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পরই আমার মা কাজ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। 

ইন্দোনেশিয়ার একটি ছোট্ট গ্রামের বাসিন্দা সুসিয়াবতী। গ্রামটি দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ লম্বকে অবস্থিত। এ গ্রামে কারও মা থেকেও বলা যায় নেই। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মায়ের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছে। ফলে তার মতো একাধিক সন্তানই একাকীত্বে ভোগে। কিন্তু তাদের মায়েদের কিছু করার নেই।

একটা সময় ছিল, ইন্দোনেশিয়া থেকে বহু মায়েরাই পেটের দায়ে বিদেশে গিয়েছেন। সুসিয়াবতীর মাও তাদের মধ্যে একজন। আর এ গ্রামে তার মতো একাধিক সন্তান রয়েছে। যারা মাতা পিতাহারা। অভিবাসী কর্মীদের এসব পরিবার বিদেশ থেকে তাদের পাঠানো অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

বিদেশে গিয়ে টাকা আয় করার বিষয়টি কিন্তু অত সহজ নয়। অনেক কষ্ট করার পর অল্পসংখ্যক কিছু টাকা আয় করতে পারেন এ মায়েরা। সেই টাকায় কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে তাদের। পাশাপাশি সন্তানদের শিক্ষিত করতেও হয়। তার জন্যও প্রয়োজন অনেক টাকার।

সুসিয়াবতীর মায়ের থেকে সেই ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, প্রতিবার তার মেয়েকে ছেড়ে যেতে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু কোনও উপায়ও নেই। বুক ফেটে গেলেও পেটের দায়ে আবারও বিদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তারা। এভাবেই দিনের পর দিন চলছে তাদের জীবনযাত্রা।

এলি সুসিয়াওয়াতীর বয়স যখন ১১ বছর, তখন আচমকাই তার বাবা-মা বিচ্ছেদ ঘটে। পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে মায়ের ওপর। সেই দায়িত্ব পূরণে গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে তার মা চলে যান সৌদি আরব। এলিকে রেখে যান নানীর কাছে।

একইরকমভাবে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কম বয়সী শিশুদের ফেলে জীবিকার খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয় হাজারো মাকে। কোথাও কোথাও কোনো গ্রামের বেশিরভাগ শিশুকেই বেড়ে ওঠতে হয় মা ছাড়া। স্থানীয়ভাবে এসব গ্রাম বা সম্প্রদায় পরিচিত হয়ে ওঠেমা-হীন গ্রামহিসেবে। এসব গ্রামের তথ্যই ফুটে ওঠেছে বিবিসির এক বিশেষ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রেবেকা হেন্সকি। পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির সংক্ষিপ্ত অনূদিত রূপ তুলে ধরা হলো-

আমি যখন প্রথমবার এলিকে দেখি তখন সে স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। আমায় বলছিল, মা চলে যাওয়ার পর থেকে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের আঘাত তখনো শুকায়নি ভেতর থেকে।

এলি বলছিল, স্কুলে বন্ধু-বান্ধবদের বাবা-মা সঙ্গে দেখলে খারাপ লাগে। আমি চাই মা বাড়ি ফিরে আসুক। মা আর দূরে থাকুক তা চাই না। আমি তাকে বাড়িতে দেখতে চাই। আমার ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা করতে দেখতে চাই।

এলির গ্রাম- ওয়ানাসাবা, ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় লম্বক দ্বীপে অবস্থিত। পুরো গ্রামটি রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়ি দিয়ে তৈরি। বাড়িগুলোর মাঝখানে ছোট্ট ব্যবধান গড়ে দিয়েছে সরু গলি। সেখানকার প্রথাটাই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শিশুদের উন্নত জীবন উপহার দেয়ার জন্য মাদের বিদেশে কাজ করাটা একরকম আবশ্যক। গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই কৃষক বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। একজন নারী বিদেশে গৃহপরিচারিকা হিসেবে যে অর্থ আয় করেন তার এক ভাগও করতে পারেন না পুরুষরা।

ইন্দোনেশিয়া থেকে নারীরা বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শুরু করেন ৮০’র দশকে। আইনি সুরক্ষা না থাকায় বাইরের দেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হন। কেউ প্রচণ্ড মারধোরের শিকার হন। কেউ যৌন নির্যাতনের। কাওকে বেতন না দিয়েই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। কখনো কখনো কেউ নতুন সন্তান নিয়ে দেশে ফেরেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় সম্মতিমূলক বা জোরপূর্বক মিলনের মাধ্যমে জন্ম নেয়া এসব সন্তানকে সহ্য করতে হয় নানা সমালোচনা।

স্থানীয় ভাষার এসব সন্তানকে ডাকা হয় আনাক ওলেহ-ওলেহ ডাকা হয়। মিশ্র জাতের হওয়ায় গ্রামের অন্যান্য শিশুদের মধ্যে তারা নজরকাড়া হয়।