ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৯০৩

মুজিববর্ষ ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:৪০ ২২ জানুয়ারি ২০২০  

মাহমুদুল হক আনসারী : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ ও ২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি পালন করা হবে দেশব্যাপী।  এর ক্ষণগণনা শুরু হয় ১০ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এর উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসকে ঘিরে ১০ জানুয়ারি ক্ষণগণনার সময় নির্ধারণ করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তরুণ প্রজš§ ও কিশোরদের কাছে উপস্থাপন করতে বিশেষভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে ‘মুজিববর্ষে’। এছাড়া জাতীয় জীবনে নতুন জীবনী শক্তি সঞ্চারিত করা হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতিকে নতুন ইচ্ছাশক্তিতে উদ্দীপ্ত করা হবে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই মুদ্রার এপিট-ওপিট। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে যেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুকে চিন্তা করা যায় না, একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিলে অর্থহীন হয়ে পড়ে বাংলাদেশও।

এ কথা তো ইতিহাসের অবিসংবাদী সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বোধকরি অপূর্ণ ও অধরাই থেকে যেত। তাই মুজিববর্ষের বছরব্যাপী কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানমালা তেমনই জাঁকজমকপূর্ণ আকর্ষণীয় ও আড়ম্বরপূর্ণ হবে। এজন্য এখন থেকেই সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে। মুজিবর্ষকে সামনে রেখে জাতীয় সংসদেও বিশেষ অধিবেশন বসবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২২ থেকে ২৩ মার্চ বিশেষ অধিবেশন চলবে। জাতীয় সংসদ ১৯ মার্চ শিশু দিবস উপলক্ষে শিশুদের নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জš§শতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’-এর অনুষ্ঠান শুরু করবে। ২২ মার্চ অধিবেশনের শুরুর পূর্বে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জাদুঘরে সব সংসদ সদস্য জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এমনিতে জাতির পিতার জন্মদিন উপলক্ষে ১৭ মার্চ জাতীয় শিশুদিবস এবং ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার দিনটিকে স্মরণ করে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়।


 
সূত্রগুলো আরও বলছে, বছরটি এমনভাবে উদযাপন করা হবে, যাতে করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে জানতে ও বুঝতে পারে। নতুনভাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অনুধাবন করে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করতে পারে। এসব অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণের স্মৃতি তুলে ধরা হয়। সরকার ইতোমধ্যে মুজিববর্ষ উদযাপনে দুটি কমিটি ঘোষণা করেছে। একটির সভাপতি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এবং তার পরিবারের অপরাপর সদস্যরা অন্য কমিটিতে থাকবেন। সরকারের সন্ত্রিসভার সদস্য, সচিব, আমলা, সাবেক সচিব ও সংসদ সদস্যরা এসব কমিটিতে থাকবেন। দেশের বরেণ্য, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, সুশীল সমাজের নেতারা এসব কমিটিতে থাকবেন। মুজিববর্ষ উদযাপন বাস্তবায়নেও নানা কমিটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। এর জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্রীয়ভাবে অস্থায়ী কার্যালয় করা হয়। মুজিববর্ষকে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন পোর্টালে ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠানমালা এসব গণমাধ্যমে প্রচার করা হবে। তবে রাষ্ট্রীয় সবগুলো অনুষ্ঠান প্রচারের পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা উপস্থাপন করা হবে। তার চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এসব অনুষ্ঠান প্রচারে যাবে বলে জানা যায়। এছাড়া বিভিন্ন আঙ্গিকে অনেক কিছু প্রকাশিত হওয়ার কথা আছে। কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হওয়ার কথা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের একটি সংকলন প্রকাশ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ৪৭টি ফাইলের ৩০ হাজার পাতাকে ৯ হাজার পাতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এটা ১৪ খণ্ডের একটি সংকলন হবে। এই রিপোর্ট পড়লে দেশের ইতিহাস জানার কিছু বাকি থাকে না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়েও কয়েকটি খণ্ডের একটি সংকলন হচ্ছে। বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হবে ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা’।


 
বিশ্লেষকরা বলছেন, আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাষণ দেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা হয়ে আছে এ অম্লান ও চিরস্মরণীয় মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যা বিশ্বে অন্যতম ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কো কর্তৃক কেবল একটি ভাষণ ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।


 
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তারই হাত ধরে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। আসছে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মের শত বছর পূর্ণ হবে। আর ঠিক পরের বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগগুলো মুজিববর্ষ উদযাপনে আলাদাভাবে কমিটি গঠন করে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মুজিববর্ষে ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নতুন বাড়ি পাবেন। আর বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা মুজিববর্ষে প্রতিদিন এক ঘণ্টা বেশি অফিস করতে যাচ্ছেন। সড়ক বিভাগ এই বছরটি ঘিরে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে এই বছরের প্রতি মাসের ১৭ তারিখে বিমান চলাচলে থাকতে পারে বিশেষ ছাড়। মুজিববর্ষ উদযাপনে ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনাও আসবে ঢাকা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এ ব্যাপারে কাজ করছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে মুজিববর্ষ উদযাপন করবে ইউনেস্কো। বিশ্ব নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ অনেক বিশ্ব নেতা মুজিববর্ষের আয়োজনে ঢাকায় আসতে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদও আসছেন ঢাকায়। ক্রীড়াঙ্গনেও নেওয়া হয়েছে বিশেষ আয়োজন। ফুটবলের তারকা খেলোয়াড়ও আসবেন ঢাকায়। তফসিলি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানরা মুজিববর্ষ উদযাপনে চলতি সপ্তাহেই ২২৫ কোটি টাকা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট তহবিলে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ উদযাপন করবে বিদেশে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোও। বাংলাদেশের সব মিশনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে লক্ষ্যে এখন চলছে প্রস্তুতি।


 
জানা গেছে, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিশেষ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে এই সময়ে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশনগুলো বিশেষ নিবন্ধ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। বঙ্গবন্ধুকে জানতে, বুঝতে মুজিবর্ষকে এ সময়ে নতুন প্রজন্মের সামনে তথ্যবহুল করে তুলতে হবে। সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্মগোত্রের কাছে জাতির জনককে এ সময়ে অধিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্ম গোত্রের ঊর্ধ্বে থেকে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও আত্মদান জাতির কাছে চির অম্লান হয়ে থাকবে। তার ও তার পরিবারের সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের উচ্চমর্যাদা দানের প্রার্থনা করছি।

ফিল্যান্স লেখক, গবেষক

[email protected]