ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৭৩

লং কোভিড কী, কেন হয়, চিকিৎসা কেমন?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:০৩ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১  

করোনাভাইরাস তার প্রাথমিক সংক্রামক অবস্থা থেকে ক্রমেই পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেকে আরও ভয়াবহ ও শক্তিশালী রূপে হাজির করছে। ফলে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি কোভিড পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রথমদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে শতকরা ৯০ জনের ক্ষেত্রেই জ্বর, কাশি, স্বাদ -গন্ধ না-পাওয়া ইত্যাদির মতো সংক্ষিপ্ত এবং মৃদু অসুস্থতা দেখা দেয় যা সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই সেরে যায়।

 

কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা গেল করোনাভাইরাস সংক্রমিতদের অনেকের জ্বর-কাশির মত উপসর্গগুলো সেরে গেলেও তারা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছেন না। অনেকের ক্ষেত্রেই তাদের ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছে। অবসন্নতা ও বুক ধড়ফড়ানি দেখা দিচ্ছে, স্মৃতিশক্তি কমে গেছে, অনেকে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারছেন না; স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে তাদের মাসের পর মাস সময় লাগছে, কাউকে কাউকে ফিজিওথেরাপি নিতে হচ্ছে।

 

এগুলো যে আসলে করোনাভাইরাস সংক্রমণেরই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া- ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। আর তখন থেকেই এই লং কোভিড কথাটা চালু হয়ে গেল। করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের লং কোভিডে ভোগার প্রবণতা ক্রমেই বাড়তে লাগলো। যারা প্রথম দফা ভাইরাস সংক্রমণে খুব একটা অসুস্থ হননি, তাদের মধ্যেও লং কোভিড হতে দেখা যাচ্ছে।

 

যেভাবে বুঝবেন লং কোভিডে ভুগছেন কিনা

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী, কেউ যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ১২ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যদি রোগীর দেহে অসুস্থতার লক্ষণ রয়ে যায়, যার কারণ হিসেবে অন্য কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে ধরে নিতে হবে তার ‘লং কোভিড’ হয়েছে। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য অনুযায়ী লক্ষণগুলো হচ্ছে:

 

১. চরম ক্লান্তি বা অবসন্নতা।

২. শ্বাস নিতে কষ্ট বা হাঁপিয়ে ওঠা, হৃৎপিণ্ডের ঘন ঘন স্পন্দন বা বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা বা টানটান ভাব।

৩. স্মৃতি শক্তি বা মনঃসংযোগের সমস্যা - যাকে বলা হয় 'ব্রেন ফগ' বা বোধশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।

 

৪. স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতিতে পরিবর্তন।

৫. হাড়ের জোড়ায় ব্যথা।

এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বৃহত্তম জরিপটি চালিয়েছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এবং তারা লং কোভিডে আক্রান্ত লোকদের ১০টি প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে এরকম ২০০টি লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন।

 

দেখা গেছে, যারা করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর পুরোপুরি সেরে উঠেছেন তাদের চাইতে লং কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যেই এসব লক্ষণ বেশি দেখা গেছে। এসব লক্ষণের মধ্যে আছে হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম, নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন, স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি লোপ, কথা বলা ও ভাষার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেয়া। অনেকের ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্র ও মূত্রাশয়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব ও ত্বকের অবস্থায় পরিবর্তন দেখা গেছে।

 

লং কোভিড কেন হয়?

লং কোভিডের ব্যাপারে এখনো সবকিছু নিশ্চিতভাবে জানেন না বিজ্ঞানীরা। একটা সম্ভাব্য কারণের কথা বলা হচ্ছে। তা হলো, করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলে তা ঠেকানোর জন্য কিছু লোকের ক্ষেত্রে তাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তা তখন শুধু ভাইরাসকে নয়, দেহের নিজস্ব টিস্যুকেও আক্রমণ করে।

 

অন্য আরেকটি তত্ত্বে বলা হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির কিছু ক্ষুদ্র অংশ রয়ে যেতে পারে, হয়তো তা সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং পরে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হার্পিস এবং এপস্টাইন বার ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে যাতে বিভিন্ন গ্রন্থির জ্বর দেখা দেয়। তবে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে বলে খুব বেশি প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

 

কাদের ঝুঁকি কতটুকু?

কোন বয়সীদের লং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি- এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এ পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা হয়েছে তাতে এটা অনেকটাই স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, রোগীর বয়স বেশি হলে লং কোভিডের সম্ভাবনা বাড়ে, এবং পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে লং কোভিড হচ্ছে দ্বিগুণ বেশি পরিমাণে।

 

যারা করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন, বা যাদের হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তাদের মধ্যে লং কোভিডের কিছু লক্ষণ বেশি দেখা গেছে, তবে সব ক্ষেত্রে নয়। করোনাভাইরাসে যারা বেশি অসুস্থ হচ্ছেন তাদের ফুসফুসের ওপর মারত্মক প্রভাব পড়ার লক্ষণ দেখছেন চিকিৎসকরা

 

লণ্ডনের কিংস কলেজ বেশ কিছু জরিপ এবং স্বাস্থ্যসম্পর্কিত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, যাদের বয়স বিশের কোঠায় এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে- তাদের ১ থেকে ২ শতাংশের লং কোভিড হতে পারে। অন্যদিকে যাদের বয়স ৬০-এর কোঠায় তাদের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা ৫ শতাংশ।

 

লং কোভিডের চিকিৎসা

ব্রিটেনে এখন ৮৯টি বিশেষ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লং কোভিড আক্রান্তদের অবস্থা যাচাইয়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। লং কোভিডের চিকিৎসার জন্য এখনো কোন প্রমাণিত ওষুধ নেই। ডাক্তাররা যা করছেন তা হলো রোগীর উপসর্গগুলোর সুশ্রুষা, এবং পর্যায়ক্রমে রোগীর শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যাদের কোভিড থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘদিন লাগে, তাদের দরকার প্রচুর বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং প্রচুর পানি পান করা। কোন কোন রোগীর হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পেতে ফিজিওথেরাপি দরকার হয়।সাধারণভাবে বলা যায়, ধূমপান না করা, মদ্যপান কমানো, শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা - এগুলো মেনে চলতে পারলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে অল্পদিনেই সেরে ওঠা সম্ভব।

 

লং কোভিডে আক্রান্ত হবার পর যারা টিকা নিয়েছেন- তাদের প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত ভ্যাক্সিন নেবার পর তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে, এবং তার ফলে শরীরে করোনাভাইরাসের কোন ক্ষুদ্র টুকরো রয়ে গিয়ে থাকলে তাকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে।

 

বাংলাদেশের চিকিৎসকরা বলেছেন, এখন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার নির্ধারিত ঢাকায় সরকারি কয়েকটি হাসপাতালে সুস্থ হওয়াদের ছাড়পত্র দেয়ার সময় ফলোআপ চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সারাদেশের সরকার- বেসরকারি সব হাসপাতালের জন্য কোভিডের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব কাটানোর চিকিৎসার কোন পরিকল্পনা বা কোন প্রটোকল এখনো নেই।

করোনাভাইরাস বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর