ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৮৮৩

আধুনিক সমাজ-সভ্যতা, নারী বনাম পুরুষ

নবনীতা চক্রবর্তী

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৭:০৯ ১২ জুন ২০২১  

রাবীন্দ্রিক যুগীয় নিরুপমাদের মতো এই সভ্য অতি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের ললনাগণ শুধু পণপ্রথার যূপকাষ্ঠে বলির পাঁঠা হয়না। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে তাদের অত্যাচারিত হওয়ার এবং একটি চূড়ান্ত পরিনতিতে পৌঁছে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলো নানামুখী।  ঘটনাগুলোও ভীষণ চমকপ্রদ।  যেন  এক প্রতিযোগিতা।  এক ঘটনা আরেক ঘটনাকে ছাড়িয়ে চলছে প্রতিনিয়ত।  


বিষয়টি এমন এক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে হতবাক,  নৃশংসতা,  বীভৎসতা,  কুৎসিত,  জঘন্য, এসব শব্দ বড্ড তুচ্ছ হয়ে পড়েছে। ব্যাকরণিকদের , ভাষাবিদদের নতুন করে শব্দ নিয়ে ভাবতে হবে অচিরেই।  পরিস্থিতি যেদিকে আগুয়ান, তাতে বাংলা শব্দ ভান্ডারে এমন সব শব্দের ভাঁড়ে ভবানী হতে বেশি দেরী নেই। শব্দের দৈন্যতা আবিষ্কার করা এই  লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমরা বরং আলো ফেলি মূল জায়গায়। 


কথা হচ্ছিল আজকের যুগের শিক্ষিত, রুচিশীল,  উদারমনস্ক, চাকরিরত,  সমাজে চলনসই ঝা চকচকে স্মার্ট নিরুপমাদের নিয়ে। নারীর ক্ষমতায়নের যুগে  তারা আসলেই যে কতটা ক্ষমতাবান বা তাদের অবস্থান কিরূপ সেটা কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়।  


গ্রাম বাংলার খুব গভীরে যাওয়ার দরকার নেই।  যেমন মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত,  আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হলো।  মারলো কে? মাদ্রাসার শিক্ষক।  এখন হয়ত আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলব, তবুও বিচার তো হয়েছে এবং সেই তৃপ্তি নিয়ে সুখে নিদ্রা যাব।  কিন্তু একটু যদি ফলাফলটি ছাড়া প্রক্রিয়ার দিকে নজর দিই তাহলে কি দেখি,  মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অপরাধীর সাজা হয়।  কি ভাগ্য আমাদের, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী না হলে বিচার হবে না।  আমরা ব্যক্তির এই অধিকারটুকু রক্ষা করতে পারিনি এবং পারিনা।  বলা ভালো, চাইনা।  

 

আমাদের মন মানসিকতা এখন এমন হয়েছে আমার তো কিছু হয়নি,  আমি কথা বলব কেন?  যার হয়েছে সে বুঝবে। সরকার বুঝবে।  আমার কি!  আর টুপটাপ পাতা ঝরার মতো ঝরে পড়ে কত নিষ্পাপ প্রাণ।  কত ইতিকে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে প্রাণ দিতে হয় । কত তনু হত্যার বিচারই আর হয়না।  কত সিমিরা আর্তনাদ অপমানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। কত মুনিয়ার মৃত্যু ঘটলে স্রোতের মতো ভেসে আসে নর্দমার কীটে কীটে পাঁক। 


সমাজ তখন উঠে পড়ে লেগে যায় প্রমানে কত নষ্ট ভ্রষ্ট ছিল তারা!!  আর আমরা মুখ বাকিয়ে টেবিল চাপড়ে,  বাজার গরম করে মুখের ফেনা তুলে বলতে থাকব একের পর এক বাক্য।  এত লোভ, ছি ছি।  আরে কাপড় চোপড় ঠিক নাই তো।

 

ছেলেধরা ওদের স্বভাব।  মা বাবা শিক্ষা দেয়নি।  সব মায়ের দোষ মেয়েকে সামলে রাখতে পারেনি। আচ্ছা আত্মহত্যা করলো কেন? একটু সহ্য করতেও পারলো না!! মা বাবার কথাটা মনে পড়লো না।  আচ্ছা গর্ভবতী হয়ে পড়েনিতো!  কি জানি বাবা কি কুৎসা ঢাকতে এমন কান্ড। কত জল্পনা কল্পনা।  কত টিপ্পনী। কথার আর শেষ নেই!!! মাঝে মাঝে বিরাম চিহ্নগুলোও লজ্জা পায়। তারপর আবার যাপিত জীবনে ফিরে যাওয়া।  পুরুষেরা তাদের মতো করে এবং নারীরা তাদের মতোন করে।  


সবচেয়ে দাগ কাটবার মতো বিষয় হল এইসব ঘটনায় কুৎসা রটনায় নারীরা প্রথম সারিতে।  দিনশেষে একরাশ গালমন্দ করে পটের বিবি আর বিলাসী জীবনের হাতছানিতে  শাড়ি গহনায় ফের মনোনিবেশ করা।  যেন কিছুই হয়নি!!! বর্তমানে খুন, জখম, পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা সিনেমার কাহিনিকেও হার মানাচ্ছে।  পূর্বে দেখা যেতো অপরাধগুলো হতো খুব একরৈখিক, যেমন ছুরি দিয়ে সরাসরি খুন বা গায়ে আগুন ধরিয়ে মেরে ফেললো।  


আর এখন, স্ত্রীকে হত্যা করে সড়ক দুর্ঘটনার কাহিনি বানিয়ে পুলিশকে এবং পরিবারকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে  এবং নিপুণভাবে অপরাধ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হেনকালে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অত্যাচারের প্রয়োজন পড়ছে না।  স্বামী একাই একশো।  বাঙালি মেয়েদের কাছে স্বামীরা সবসময়ই নায়ক।  সেই নায়কই যখন খলনায়ক তখন ভাষা হারিয়ে যায় আমাদের। আমরা তখনও অদ্ভুতভাবে সেই নারীটির আদ্যোপান্ত খুটিঁয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা শুরু করি। যদি পাওয়া যায় অতি আনন্দে মূল ঘটনাকে আড়াল করে তার চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করতে থাকি।  আর নিতান্তই কিছু খুঁজে না পেলে ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে ভাগ্যের দোহাই দিতে থাকি। ভাবখানা এমন মেয়ের কপাল খারাপ!! সবাই তো আর সমান না!!  


সম্প্রতি এস. পি বাবুল আক্তারের কথাই ধরা যাক।  পাঁচ বছর আগে কে না দেখেছে ক্যামেরার সামনে  স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামীর বুকফাটা আর্তনাদের দৃশ্য।  নিজে বাদী হয়ে মামলা, বিচার চাওয়া,  জঙ্গি হামলা সন্দেহে সাড়াঁশি অভিযান।  এ যেন সিনেমা, নাটক।  বড়ই আমোদ প্রিয় জাতি কিনা আমরা!! কত আয়োজন!!  অথচ এখন শেষে দেখা গেলো সবকিছুর হোতা সেই এস. পি. বাবুল!! স্বামী যখন আসামি।


মোটেও মশকরা নয়। তবে নারীদের জীবনটা ঠাট্টা মশকরায় এসে দাঁড়িয়েছে।  চাইলেই তাকে চোখ রাঙানো যায়, একটু আওয়াজ করলে তার টুটিঁ চিপে তাকে ফ্যালা ফ্যালা করা যায়। তাকে পিটিয়ে, পুড়িয়ে, পাশবিক নির্যাতন করে খুন করা যায়। তাকে ইভটিজিং করে,  সাইবার বুলিং করে সামাজিকভাবে অপদস্ত অপমান করা যায় মেরেও ফেলা যায়।  হাতের সুখ না করতে পারলেও দিনের পর দিন মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। আবার মানবিক বিয়ে, চুক্তিভিত্তিক বিয়ে, হাজার রকম অদ্ভুত ও অযৌক্তিক বিয়ের বিধান দিয়ে তাকে ভোগ করা যায়। 


কতটা নিচে নেমে যাচ্ছে আমাদের বুদ্ধি ও বিবেক। ভোগবাদ কতখানি মাথা চড়া দিয়ে উঠলে নীতি নৈতিকতা,আইনকানুন, বিধি বিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যা খুশি করা যায়।  যেন যেমন ইচ্ছে আমার কবিতার খাতা। নারীরা  হচ্ছে সেই নিপীড়ন এবং শোষণের অন্যতম শিকার এবং সহজ লক্ষ্যবস্তু । 


সবচেয়ে দুরাশার কথা হচ্ছে নারীর এই অবস্থার কথা পুরুষ কতটুকু বুঝতে পারেন। সেটার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে নারীরা নিজে সেটি কতটুকু  উপলব্ধি করে!!  


প্রশ্ন থেকে যায়।  বেগম রোকেয়ার  " অবরোধবাসিনী"দের অবরোধ কি ঘুচেছে? এখনও  স্বামী যখন গ্রহ-নক্ষত্রের হিসেব কষেন, তখন স্ত্রী বালিশের দৈর্ঘ্য প্রস্থের হিসেব রাখেন। কিন্তু নারীদের এটিই শিখানো হয়। যদি  ফিরে তাকাই পিতৃতান্ত্রিক শাসন আর দম্ভের ভারে ন্যুব্জ প্রচলিত সমাজ কাঠামোর দিকে তাহলে কি দেখতে পাই?

 

- দেখতে পাই একজন নারীকে এটি শিক্ষা দেওয়া হয় : তুমি প্রথমত একজন নারী, তুমি দুর্বল,  তুমি অবোধ, লজ্জাই তোমার ভূষণ, চুপ করে থাকা তোমার ধর্ম, তোমার নিজের দায়িত্ব নেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই,  তুমি বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত হবে পিতা, ভ্রাতা, স্বামী এবং পুত্র দ্বারা।  তোমার নিজস্ব কোন চিন্তা থাকার দরকার নেই, তাই তোমার মূল স্থান সংসার। আর এটিকে স্বার্থকরূপে (যেনতেন প্রকারে)  টিকিয়ে রাখার একমাত্র দায়িত্ব তোমার।  


তাই আজও একটি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে সবচেয়ে বেশি মানসিক ও সামাজিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীদের। এখানে সমাজের ভূমিকা থাকে অতি তৎপর। আজও মেয়ে সন্তানের বাবাদের কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে থাকতে হয় কণ্যাদায়গ্রস্ত পিতা অপবাদে ।  


অপরদিকে কিছু সাবেকি ধ্যানধারণা ও চিন্তাভাবনা পুরুষদের করে তুলছে কতৃত্ববাদী। কিভাবে তাদের চিন্তায় আমরা বৈষম্য বপন করি, কিভাবে তাদের নিয়ন্ত্রক হতে সাহায্য করি, সেটা যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে,  আমরা ঠিক এভাবেই পুরুষদের শিক্ষা দিয়ে থাকি :  তুমি প্রথমত একজন পুরুষ, তুমি মেধা, মনন এবং দৈহিক অবয়বে শক্তিশালী (খর্বকায় হলেও সোনার আংটি বাঁকাও ভালো জাতীয় স্তোকে বিধান আছে) , পরিবারের।

 

অর্থাৎ  জননী, জায়া, কন্যার ভরণপোষণের দায়ভার তোমার এবং তাদের চিন্তা ভাবনা করার  দায়িত্বও তোমার। অর্থ অর্জনের সক্ষমতা এবং দায়িত্ব এককভাবে তোমার কর্ম।সন্তান উৎপাদনে তোমার ইচ্ছাই প্রধান এবং তুমিই মুখ্য ভূমিকা পালনকারী, নারী আধার মাত্র।  এমন বহুমাত্রিক সাবেকি ধ্যানধারণার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে পুরুষের চিন্তাকে।

 

সত্যিকার অর্থে প্রাচীন চিন্তাভাবনা ও সাবেকি একটি ফ্রেমে বন্ধনে বন্দি নারী পুরুষ উভয়েই।  উন্নতি ঘটেনি বহুকাল থেকে চলে আসা দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা, মূল্যবোধ, অবস্থা ও ব্যবস্থার এবং নারী ও পুরুষের অবস্থানগত বৈষম্যের। 

 

পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা থেকে মাতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সমাধান টানা এই নিবন্ধের একেবারেই উদ্দেশ্য নয়, বরং সমাজ কাঠামো হওয়া প্রয়োজন মানুষতান্ত্রিক। যেখানে প্রতিটি মানুষ সমান অধিকার, সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে।  ঠিক এখানেই রয়েছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র শুধু একটি সাংবিধানিক বিষয় নয়। গণতন্ত্র ব্যক্তি মানুষের চিন্তা, বিবেক, কর্ম ও বাক স্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার। ব্যক্তির চূড়ান্ত অধিকার নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের কাজ যা রাষ্ট্র, সরকার বা সমাজ প্রধান হয়। পরিপূর্ণভাবে ব্যক্তি প্রধান। নিজস্ব পরিচয় ও স্বতন্ত্রতা যেখানে মূল নিয়ামক হিসেবে দন্ডায়মান হয়।  

 

অধিকার কেউ কাউকে দেয় না।  অধিকার আদায় করে নেওয়ার মধ্যেই প্রভূত সফলতা। তবে কয়েকটি দাবি আদায়ের মধ্যে যদি অধিকারবোধ সীমিত থাকে বা কয়েকটি দাবি আদায় যদি আমরা অধিকার বুঝি সেটি কাজের কাজ কিছু হবে না।

 

অধিকার, মর্যাদা, পরিচয় সামগ্রিকভাবে একটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। সমাজ কাঠামো পুরুষ বা নারীভিত্তিক নয়, হওয়া উচিত মানুষভিত্তিক। সুদৃঢ়  হওয়া দরকার লিঙ্গ বৈষম্যবিহীন আর্থ-সামাজিক অবস্থান। আমরা কবে সেই শক্তিতে, বোধে, বুদ্ধিতে বলীয়ান হবো। কবে আওয়াজ তুলবো।  নিজেদের আগে নিজে সম্মান করতে শিখবো।  প্রাণ খুলে বাঁচতে শিখবো। মানুষ হিসেবে বাঁচা বলতে কি বুঝায়, সেই বোঝাপড়াটা করে নিবো। এই  ঘরে এবং বাইরে, মননে এবং কর্মে লড়াইটা আমৃত্যু।।  জীবনমাত্র অধিকার থাকুক নারী ও  পুরুষ উভয়ের।
  
 

নবনীতা চক্রবর্তী
সাংস্কৃতিক কর্মী, লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এ্যান্ড সায়েন্স