ঢাকা, ১০ মে শনিবার, ২০২৫ || ২৬ বৈশাখ ১৪৩২
good-food

পাকিস্তানে হামলার পর ভারতের চোখ বাংলাদেশের দিকে কেন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ০৫:৫২ ১০ মে ২০২৫  

স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী অংশে পাকিস্তানপন্থী অবস্থান ও ভারতের প্রতি প্রকাশ্য বিরূপতা লক্ষ্য করা গেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি করছে। ফলে ভারত যখন পাকিস্তানে অপারেশন সিঁদুর চালায় তার পরপরই বাংলাদেশের গতিবিধি চোখে চোখে রেখেছে। 

 

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার একটি উচ্চপদস্থ সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্ট এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানে চলমান সামরিক উত্তেজনায় বাংলাদেশ বেশ কিছু অস্বাভাবিক কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে একটি পদক্ষেপ ছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সামরিক মহড়া 'আকাশ বিজয় ২০২৫'।
 

 

দ্য প্রিন্টের তথ্যানুযায়ী, যেহেতু ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালাচ্ছে, তাই দিল্লির উচিত এবার ঢাকার উপরও তীক্ষ্ণ নজর রাখা। প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করা হয়। এই মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল বিমান বাহিনীর অপারেশনাল প্রস্তুতি এবং কৌশলগত সক্ষমতা প্রদর্শন করা।

 

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সদর দপ্তরের নির্দেশনায় সকল ঘাঁটি এবং ইউনিট যুদ্ধ বিমান, পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার, মনুষ্যবিহীন বিমানযান, রাডার সিস্টেম এবং বিভিন্ন বিমান প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্ম এই মহড়ায় অংশ নেয়। এছাড়াও বিমান বাহিনীর নেতৃত্বে এই মহড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স ও বিএনসিসির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে।
 

 

এ সময় মহড়ায় উপস্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কূটনৈতিক ভাষায় একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি রয়েছে।  ভারত ও পাকিস্তান এখনো সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে শুরু হতে পারে যুদ্ধ, এমনই ইঙ্গিত দেয়। এই প্রেক্ষাপটে, অপ্রস্তুত থাকা আত্মঘাতী হওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়।’ 
 

 

এছাড়াও তিনি লালমনিরহাট বিমানঘাঁটির দ্রুত আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখের পাশাপাশি বিমান বাহিনীকে এর অপারেশনাল প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দেন। 
 

দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি গোপন বৈঠকের কার্যবিবরণী শেয়ার করে ভারতের গোয়েন্দা সূত্রটি বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোঃ মঞ্জুর কবির ভূঁইয়াকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘লালমনিরহাট বিমানঘাঁটির পুনর্গঠন তাদের জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি। বিমান বাহিনী প্রধান এবং এর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ  সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত। এই উদ্যোগটি অন্য কোনো দেশের স্বার্থের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং এটি তাদের  নিজের জাতীয় চাহিদা থেকে উদ্ভূত।’
 

 

কিন্তু পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার অনেক আগে, গত ২৩ জানুয়ারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার চারজন ঊর্ধ্বতন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল কঠোর গোপনীয়তার সাথে বাংলাদেশ সফর করে। এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানের নবনিযুক্ত এনএসএ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ আসিম মালিক। সেই সাথে আরো ছিলেন আইএসআই-এর বিশ্লেষণ মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শহীদ আমির আফসার, মেজর জেনারেল আলম আমির আওয়ান এবং স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি) কর্মকর্তা মুহাম্মদ উসমান লতিফ। তারা বিকেল ৫টায় ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান।

 

 

পরে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেহেদী তাদের স্বাগত জানান। প্রতিনিধিদলটি বেশ কয়েকটি বিমান ঘাঁটি এবং সামরিক স্থাপনা পরিদর্শন করেছে। এছাড়াও জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকও করেছে তারা।
 

 

এই সফরের পূর্বে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ১৩-১৭ জানুয়ারির মধ্যে একটি বাংলাদেশী প্রতিনিধিদল অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে পাকিস্তান সফর করেন। প্রতিনিধিদলটি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জাসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পাকিস্তানী কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছে বলে জানা গিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রীর সাথেও গোপনে বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদলটি।
 

 

তখন বাংলাদেশী প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের উন্নত সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান অর্জনে উল্লেখযোগ্য আগ্রহ প্রকাশ করে। এছাড়াও লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আধুনিক উদ্যোগ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং স্থানীয়ভাবে উন্নত প্রযুক্তিগত কাঠামোর প্রশংসা করেন। সেই সাথে তিনি মুনির জেএফ-১৭ থান্ডার জেট এবং অন্যান্য আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বৈঠকে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে উভয় দেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
 

 

প্রতিবেদনটিতে ‌‘ইউনুস কিন্তু হাসিনা নন’ নামে একটি পয়েন্টে বাংলাদেশে চীনা প্রভাবের বার্তা, ভারতের প্রতি অনাস্থার ইঙ্গিতের কথা বলা হয়েছে।  সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস মার্চ মাসে চীন সফরকালে বেইজিংকে আহ্বান জানিয়েছেন, দেশটিতে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে। চার দিনের সফরে ইউনুস বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ভূমিবেষ্টিত হওয়ায় সাগরে প্রবেশের কোনও সরাসরি পথ নেই— আর এটাই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ। এসময় তিনি বাংলাদেশকে আঞ্চলিক “সমুদ্রপথের একমাত্র অভিভাবক” হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
 

 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন (অব.), যিনি একসময় কাশ্মীরের শ্রীনগর-ভিত্তিক ১৫ কোরের জিওসি ছিলেন, একটি মতামতপ্রবন্ধে লিখেছেন— “যতদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানের আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু ইউনুস, যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন, তার কোনো বক্তব্যই ভারতপ্রীতি দেখা যায়নি।”
 

 

আতা হাসনাইন আরও লেখেন, “বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের আইএসআই দ্বারা প্ররোচিত ও পরামর্শপ্রাপ্ত। আইএসআই স্পষ্টতই সুযোগের আশায় আছে, যেখানে ভারতের কৌশলগত দুর্বলতা কাজে লাগানো যাবে। গত ছয় মাসে আইএসআই অনেকদূর এগিয়েছে তাদের আগ্রহ প্রকাশে। শীর্ষ আইএসআই কর্মকর্তাদের কৌশলগত এলাকা পরিদর্শন ছিল তাদের বার্তা দেওয়ার পন্থা।”
 

 

তিনি স্পষ্ট করে সতর্ক করেন, “হাসিনা ছিলেন বলেই ভারতে আশ্বাস ছিল। এখন ইউনুস আছেন ঢাকায়— দিল্লির উচিত তার পূর্বপ্রতিবেশীর দিকে সতর্ক নজর রাখা।”
 

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর