ঢাকা, ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৬১৭

ছাদকৃষি নয়, নাগরিক নোংরামোই এডিসের প্রকৃত প্রজনন ক্ষেত্র

নবীরুল ইসলাম বুলবুল

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:১০ ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

'ছাদবাগানে এডিস মশা জন্মায়' - কতিপয় বিভ্রান্ত পণ্ডিতের এ ধরণের গলাবাজিতে, নগর ও মানব জীবন স্বস্তিময় করায় অপরিহার্য উপাদান, ছাদবাগান, আতঙ্কের অপর নাম হয়ে উঠেছে। কোন নগরের ২৫% জায়গা বৃক্ষ-লতা-গুল্মে সবুজ থাকার কথা। ঢাকা মহানগরীতে ৫% জায়গা সবুজ আছে কিনা, সন্দেহ।

এই নগরে প্রায় ২ কোটি মানুষের ঠাসাঠাসি বসবাস। প্রত্যেক মানুষ তার নাকের দুই ছিদ্র দিয়ে ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন টানছেন জীবন-প্রবাহ অব্যাহত রাখার অপরিহার্যতায়। অক্সিজেন নেই, জীবন নেই। ঢাকা মহানগরীর এই দুই কোটি মানুষ চাল-ডাল-নুন-তেল বাজার থেকে প্রত্যহ কিনে থাকেন; আমার জিজ্ঞাসা, অক্সিজেন কিনেন কোন দোকান থেকে! - জানি এর কোন জবাব নেই।

জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন যে প্রয়োজন, সে কথাই হয়ত জানা নেই, অনেকেরই। সবারই জানা প্রয়োজন যে এক মিনিট অক্সিজেন প্রকৃতি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলে, আমরা, পিতা-মাতা-স্বামী/স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-নাতি-পুতি অর্থাৎ পুরো বংশ অদৃশ্য হয়ে যাবো পৃথিবীর ওপর থেকে। খাবার না খেলে মানুষের মৃত্যু এতো তাড়াতাড়ি হয় না, যতটা হয় অক্সিজেনের অভাবে।

সুতরাং অক্সিজেনের চেয়ে জরুরি কোন খাবার নেই। এই অতিজরুরি খাদ্যের উৎপাদক একমাত্র বৃক্ষ-লতা-গুল্ম। এরাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রেখে সবার জন্য অক্সিজেনের সরবরাহের অব্যাহত সমতা নিশ্চিত করে সব মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে নীরবে-নিভৃতে। আমরা ঢাকা মহানগরীর নাগরিকগণ বৃ্ক্ষ-লতা-গুল্ম কেটে পুত-পবিত্র হয়ে এডিস মশার কামড় থেকে বাঁচার কসরত করছি।

'নবাব সিরাজুদ্দৌলা' সিনেমায় 'গোলাম হোসেন' বলেছিলেন, "হারামজাদারা, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝলো না"। 
আমরা তখন না বুঝে স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম, বৃক্ষ-লতা-গুল্মের মর্যাদা না বুঝলে জীবন হারাবো।

এডিস মশার জীবনচক্রের চারটি পর্যায় এর তিনটিই পানিতে, নয়তো পানির সাহচর্যে। পরিণত মশা পানিতে, নয়তো, পানিতে ডুবার সম্ভাবনা আছে এমন জায়গায় ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে পানিতে সাঁতার কেটে বেড়ায়। সাঁতার শেষে গুটিশুটি মেরে চুপচাপ রেষ্ট নেয় পিউপারূপে। পিউপা পানির উপরিস্তরে ডুবন্ত অবস্থায় ঝুলে থাকে। পিউপা খোলস ভেঙে পরিণত হয় পুরুষ ও স্ত্রী মশায়। স্ত্রী এডিস মশা, তার নিজের ডিম ফুটানোর স্বার্থে, মানবদেহে হুল ফুটিয়ে রক্ত টেনে নেয়। তখনই সে দিয়ে যায়, তার শরীরে থাকা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া-জিকা-ইয়োলোফিভার-এর ভয়াবহ রোগের জীবাণু। আমরা রোগাক্রান্ত হই।

আমি একজন কৃষিবিদ। আমার জিজ্ঞাসা, কেউ কি বলতে পারবেন, ছাদে ধান চাষ হয়, তিতাপাটের চাষ হয়, জলজ কলমি চাষ হয়! আশা করি পারবেন না। ওগুলোর জন্য জমা জল দরকার। আমি জোর দিয়েই বলতে পারি, জল জমে থাকা প্রয়োজন, এমন কোন গাছের চাষ ছাদবাগানে হয় না।

শাপলা জাতীয় জলজ ফুল ব্যতিত কোন ফুল, কলমী জাতীয় জলজ শাক ব্যতিত কোন শাক এবং কোন ফল গাছই জলে জন্মায় না। পানির আধিক্য ফুল-ফল-শাক-সবজি গাছের মৃত্যুর কারণ। কোন শৌখিন ছাদকৃষক কোন মোহে গাছের গোড়ায় বিপুল পানি ঢালতে যাবেন! তার উদ্দেশ্য ও উদ্যোগ ওগুলো ফলানো, মারা নয়; তাছাড়া এডিস মশার চাষ এমন কোন লোভনীয় কৃষিও নয়।

যে সকল পণ্ডিত বলছেন, এডিস মশা বিস্তারের প্রধান ক্ষেত্র ছাদবাগান, তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আমি মানছি, পরিত্যক্ত টব অযত্নে পড়ে থাকলে তাতে পানি দীর্ঘদিন জমলে মশা জন্মাতে পারে। তাতে অন্তত ৯ দিন পানি জমে থাকতে হবে। বর্ষাকাল না হলে তা অসম্ভব। বাগান বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই কোন সক্রিয় সজীব ছাদবাগানে পানি জমে এডিস মশা জন্মাবার কোন অবকাশ নেই। ছাদ-কৃষক এ কথা ভালো করেই জানেন।

ছাদকৃষি কোনক্রমেই নয়, নাগরিক নোংরামোই এডিস মশার প্রকৃত প্রজনন ক্ষেত্র। জলসংকট হতে পারে সে আশংকায় বালতিতে, ড্রামে দিনের পর দিন পানি জমিয়ে রাখার অভ্যাস আমাদের আছে; আমাদের লো-ডাইন নষ্ট, ফ্লাশ হয় না, তাতে নেই ঢাকনা, জমে থাকে পানি; নানা ধরণের পলিথিন প্যাকেট আমরা এখানে-সেখানে ফেলি, তাতে জমে পানি; পুরাতন টায়ার পড়ে থাকে অযত্নে, জমে পানি; প্রবাহহীন খোলা ড্রেন, জমে পানি; খালবন্ধ, প্রবাহহীন, জমে পানি; ঢাকা নিজেই নীচু, চারিদিকে নীচু মাঠ, বৃষ্টি হলেই জমে পানি; জমা পানি নেই কোথায়! এডিস মশা জন্মাবে না তো, জন্মাবে কী!

আমরা ঘর থেকে মাকড়সা তাড়িয়েছি, টিকটিকি তাড়িয়েছি, কুনো ব্যাঙ তাড়িয়েছি, অথচ আবহমান কাল থেকে এরাই ঘরের মশা খেয়ে এসেছে। সোনা ব্যাঙ আমরা বেঁচে খেয়েছি, নির্বিচারে বিষ দিয়ে মেরেছি, নয়তো মেরে খেয়েছি টাকি, শোল, গজাল, শিং, মাগুর; মশার ডিম-লার্ভা-পিউপা-এডাল্ট খেয়ে সাফা করাই যাদের কাজ।

প্রকৃতিকে ঢিল মারলে, প্রকৃতি পাটকেল মারবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার কথা মনে না রেখে, শুধু ছাদবাগান ধ্বংশে সমাধান খুঁজলে মরীচিকায় ছোটা হবে।

বাঁচতে হলে নগরকৃষিকে উৎসাহ দিতে হবে, নগরকৃষি নিয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা বাড়াতে হবে, মশার প্রাকৃতিক শিকারী মাছ, ব্যাঙ, টিকটিকি, মাকড়সা ফিরিয়ে আনতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে শক্তিশালী করতে হবে, ক্ষমতা দিতে হবে ও দায়বদ্ধ করতে হবে।

নাগরিক সচেতনতা সবচেয়ে ভালো উপায় মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এডিস মশার ভয়াবহতা জানিয়ে মশা দমনে নাগরিক ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া। শিশুরা অমিত ক্ষমতার অধিকারী, তারাই পারে সমাজ বদলে দিতে, নাগরিক-নোংরামোর পাকচক্র থেকে বের হয়ে আসতে তারাই পারে কার্যকর অবদান রাখতে, তারা ঘর থেকে প্রতিরোধ করবে। সর্বোপরি, 'পরিষ্কার-পরিছন্নতা ঈমানের অঙ্গ' এ সত্যে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে একটু সত্যিকার ইমানদার হতে হবে।

সুপরিকল্পিত সমবেত প্রচেষ্টা বিনে কেবল "ছাদবাগান এডিস মশার রাজপ্রাসাদঃ বিভ্রান্তির মায়াজাল"-এ আটকে 'ফুলেরটব'কে দোষারোপ করে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া-জিকা-ইয়োলোফিবার-এর চতুর্মুখী আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না।

# লেখক : নবীরুল ইসলাম বুলবুল, কৃষিবিদ