ঢাকা, ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৭৯০

পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন:জাপা চেয়ারম্যান কে?

রওশন-কাদের মুখোমুখি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৬:১০ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

জাতীয় পার্টিতে নতুন করে নাটক শুরু হলো। দলটির সদ্য প্রয়াত নেতা, সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ভাই জিএম কাদের দু’জনেই নিজেকে দলটির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার সকালে একটি সংবাদ সম্মেলন করে দলটির একাংশ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে তাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করে।

এর কয়েক ঘণ্টা পরে আরেক অংশ জিএম কাদেরকে তাদের বৈধ চেয়ারম্যান বলে দাবি করে।

জিএম কাদের জেনারেল এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এসব ঘোষণায় দলটি আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে বলে এর নেতাকর্মীদের অনেকে বলেছেন। আর এসবের মধ্য দিয়ে নতুন মাত্রা পেল দেবর-ভাবির টানাপড়েন।

এই দুই শীর্ষ নেতাই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে সংসদে স্পিকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

রওশনপন্থীদের সংবাদ সম্মেলন  
এরশাদপত্নী রওশনকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন তার অনুসারীরা।

রওশন এরশদের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সকালে তার বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী ৬ মাসের মধ্যে কাউন্সিল হবে। সেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থায়ী চেয়ারম্যান ঠিক করা হবে।

এরশাদের ভাই জিএম কাদের জাতীয় পার্টির ‘গঠনতন্ত্র ভেঙে’ চেয়ারম্যান হয়েছেন অভিযোগ করে আনিসুল বলেন, জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের সম্মান দেবেন রওশন এরশাদ।
এ ঘটনায় জাপার রাজনীতিতে নতুন করে বিভক্তির বিষয়টি ফের চাঙ্গা হলো বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। 

দলে বিভাজনের বিষয়টি স্বীকার করে সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা রওশন বলেন, পার্টি এখন উদ্বিগ্ন আছে। পার্টিতে কী হচ্ছে? জাপা অতীতেও ভাগ হয়েছে, এবারও কি সেটি হচ্ছে নাকি?

তিনি বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এত কষ্ট করে পার্টি গড়ে তুলেছেন, এখন সেই পার্টিটা ভালেভাবে চলুক, মান অভিমান ভুলে যারা চলে গেছে, তারা ফিরে আসুক। আমি চাই পার্টির সবাই মিলেমিশে জনগণের সেবা করব।

অবশ্য রওশনের সঙ্গে মহাসচিব পদে মসিউর রহমান রাঙ্গাই থাকছেন বলে জানান আনিসুল। তবে রওশনের বাসায় এই সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গা উপস্থিত ছিলেন না। 

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ছাড়াও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু, মজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, এসএম ফয়সল চিশতী, মীর আবদুস সবুর আসুদ, খালেদ আখতার, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন খোকা ও সেলিম ওসমান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। 
ভেতরে যখন সংবাদ সম্মেলন চলছিল, বাইরে তখন হাজার হাজার নেতাকর্মী স্লোগানে মুখর করে তুলেন বাসবভন প্রাঙ্গণ। 

জিএম কাদেরের সংবাদ সম্মেলন

রওশনপন্থীদের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই জিএম কাদের পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে আসেন।

সেখানে তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এবং দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, সে হিসাবেই তিনি বৈধভাবে পার্টির চেয়ারম্যান রয়েছেন।

জাতীয় পার্টি ভেঙ্গে গেল কি-না বা বিভক্ত হলো কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ''কেউ ঘোষণা দিলেই পার্টি ভাগ হয়ে যায় না।'
রওশন এরশাদকে যারা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেন জিএম কাদের।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখে পড়েনি।

তিনি বলেন, ৮ তারিখ সংসদ শুরু হচ্ছে। তার আগেই আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার ছিল। ওনার (এরশাদ) মৃত্যুর পরে যে প্রেসিডিয়াম মিটিং করেছিলাম সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সবাই একমত ছিল যে, আমি চেয়ারম্যান হিসেবে যেন পার্টির দায়িত্ব পালন করি।

তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র মোতাবেক যেভাবে দেয়া উচিৎ সেভাবে দেয়ার পরিস্থিতি আছে কিনা। সেটা যখন আমি আলাপ-আলোচনা করলাম তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে, আমরা এ বিষয়ে স্পিকারকে চিঠি দিতে পারি।
জিএম কাদের বলেন, যে কেউ ইচ্ছা করলেই নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করতে পারেন না। এর জন্য দলের গঠনতন্ত্র রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমি পার্টির চেয়ারম্যান।

স্পিকারকে দেয়া চিঠির বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, পার্লামেন্টারি বোর্ডের অধিকাংশের মতামত নিয়ে আমাকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে এ চিঠি দেয়া হয়েছে। অন্তত ১৫ জন সংসদ সদস্য আমাকে বিরোধীদলীয় নেতা হতে অনুরোধ করেছেন। তাদের অনুরোধের ভিত্তিতে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এই চিঠি স্পিকারকে পৌঁছে দিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এরশাদ সাহেব জীবিত থাকাবস্থায় যেভাবে বোর্ড গঠন করেছিলেন, সেভাবেই করা হয়েছে। শুধু একজন সদস্য নিজে থেকে সরে যেতে চাইলে তার স্থানে কাজী ফিরোজ রশীদকে যুক্ত করেছি। জাতীয় নির্বাচন ও একটি উপনির্বাচনে একই বোর্ড নাও হতে পারে। পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই আমি দায়িত্ব পালন করছি।’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপিসহ নেতাকর্মীরা। 

সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব
এরশাদ জীবিত থাকাকালেই জাতীয় পার্টির পদ বণ্টন ও অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে রওশনের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য। তবে, সে বিরোধ সামাল দিয়ে আসছিলেন সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ।

অসুস্থ থাকা অবস্থায় এরশাদ গেল এপ্রিলে তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। এরপর থেকে রওশন ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে দলীয় কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছিল না।

গত ১৪ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ।

তার চার দিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নাম ঘোষণা করা হয়। এরশাদের স্ত্রী রওশন ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না।

১৮ জুলাই ওই সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১ (ক) ধারা অনুযায়ী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, তার অবর্তমানে জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হবেন।আজ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জি এম কাদেরই আজ থেকে দলের চেয়ারম্যান হবেন৷

এরপর থেকে ভাবি রওশনের সঙ্গে কাদেরের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়। রওশন অভিযোগ করেন, জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার আগে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মতামত নেয়া হয়নি।

অন্যদিকে জি এম কাদের বলেছিলেন, দলে কোনো সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবেন তারা।

চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে বুধবার জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ঘোষণার জন্য স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে চিঠি পাঠানো হয় জাতীয় পার্টির নামে।

এর পাল্টায় স্পিকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে রওশন বলেন, দলীয় ফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই জি এম কাদের নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করতে বলেছেন।

এর জবাবে জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ভাই এরশাদ ‘যেভাবে’ সিদ্ধান্ত নিতেন, তিনিও ‘সেভাবেই’ নিয়েছেন।

এখন দেখার বিষয়, সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের নেতৃত্বে গড়া ক্ষয়িঞ্ষু দলটির নেতৃত্ব এবং দ্বন্দ্বের মুখে নতুন করে ভাঙ্গন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।