ঢাকা, ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৫২০

লকডাউনের মধ্যেই অন্য রাজনীতি

সাবেক জামাতরাই গড়লেন নতুন দল

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৫:১৮ ২ মে ২০২০  

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর ‘সংস্কারপন্থিরা’ নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের এক বছর পর ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।

 

শনিবার রাজধানীর বিজয় নগরে সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণা করেন এক বছর আগে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে গঠিত ওই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক বহিষ্কৃত জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু।

 

নতুন দলের নাম ঘোষণার পাশাপাশি ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে।

 

এ দলে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব। আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু এ কমিটির সদস্য সচিব।

 

সংবাদ সম্মেলনে মঞ্জু বলেন, ‘‘সমালোচকদের তীর্ষক ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে আমাদের দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’- এবি পার্টি।

 

“আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি সেই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে বদ্ধ পরিকর।”

 

বিজয় নগরে ‘সায়হাম স্কাই ভিউ’ টাওয়ারে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের ব্যানারে লেখা ছিলো - সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ পুনর্গঠন করে নতুন রাজনৈতিক দল আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান।

 

সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল ওহাব মিনার। তিনি বলেন, ‘ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে’ প্রতিটি মানুষের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে উন্নীত করা’ হবে এ সংগঠনের উদ্দেশ্য।

 

এবি পার্টির ৭ দফা কর্মসূচিতে বলা হয়- জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রেরণা সৃষ্টি, উন্নয়ন ও গবেষণা, নেতৃত্ব তৈরি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে এ দল। আর ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’থাকবে এবি পার্টির ‘রিসার্চ উইং’ হিসেবে।

 

মঞ্জু বলেন, আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব হবে সব জেলায় কমিটি গঠন করা, দলের খসড়া গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা এবং দ্রুততম সময়ে গণতান্ত্রিক ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় কনভেনশন করে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা।

 

করোনাভাইরাসের মহামারী মোকাবিলায় ‘জনগণের পাশে থাকার’ অঙ্গীকার জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যে ২০ হাজার বিপদগ্রস্থ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি শুরু করেছি। আপাতত আমাদের পরিকল্পনা হল- এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ, মানব সেবাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মনোনিবেশ করা এবং নীতিনির্ধারণী সুপারিশমালা প্রণয়ন।”

 

মহামারীর দুর্যোগ কেটে গেলে নতুন দলের কার্য্ক্রম শুরু হবে বলে জানান এবি পার্টির সদস্য সচিব।

 

সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আইনি লড়াই চালানো ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমদ ভুঁইয়া, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদসহ কয়েকজন।

 

আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার আগ পর্যন্ত এএফএম সোলায়মান চৌধুরী অতিথির আসনে বসা ছিলেন; কমিটি ঘোষণার পর তিনি মঞ্চে আসেন।

 

সোলায়মান চৌধুরী এক সময় ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শুরা সদস্য এবং জাতীয় পেশাজীবী ফোরামের সভাপতি। গত বছর ডিসেম্বরে তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ এর সাথে যুক্ত হন।

 

সাবেক সচিব সোলায়মান চৌধুরী রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের সময় ফেনীর জেলা প্রশাসক থাকাকালে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক আলোচিত হন এই আমলা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা-৯ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন।


মজিবুর রহমান মঞ্জুও জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য ছিলেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি হওয়ার আগে চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেন।

 

মঞ্জু ২০১৮ সালে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে ‘জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে ওই প্ল্যাটফর্ম গঠন করে তিন মাসের মধ্যে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপর প্রায় একবছর তাদের আর কোনো সক্রিয়তা দেখা যায়নি।

 

জামায়াতের সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।

 

পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ।

 

সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মত যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। সেই অপরাধে সর্বোচ্চ আদালতে এ পর্যন্ত জামায়াতের সাত শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

 

১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের মতো ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাদের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেন। আর জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যুদ্ধাপরাধী দুই জামায়াত নেতাকে দেন মন্ত্রিত্ব।

 

একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে আদালতের একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।

 

শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইনি কাঠামো তৈরির কাজ করছে সরকার।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীতে সংস্কার নিয়ে ১৯৭৯ সাল থেকে বিরোধ চলে। ১৯৭৭ সালে ধর্মভিত্তিক দল গঠনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর জামায়াত নেতারা মাওলানা আবদুর রহিমের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী জামায়াত নেতা গোলাম আজম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে জামায়াতে ইসলামীকে পুরুজ্জীবিত করেন; দলচ্যুত হন মাওলানা আবদুর রহিম।

 

সংস্কারের দাবিতে ১৯৮১ সালে ছাত্রশিবিরে এবং ২০০৭ সালে জামায়াতে ফের অস্থিরতা দেখা দেয়। ২০১০ সালেও জামায়াতের নেতৃস্থানীয় পর্য়ায়ে সংস্কারে দাবি উঠেছিল। প্রতিবারই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের শক্ত হাতে দমন করেছে।

 

যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, এম কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলীর মতো শীর্ষ নেতারা দণ্ডিত হলে জামায়াত ব্যাপক চাপে পড়ে। এর মধ্যে একটি অংশ দলে সংস্কারের দাবি তোলে।

 

২০১৮ সালে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা দিলে সংস্কারপন্থিরা আরও জোর পায়। তখনই রাজ্জাকের মতো মত প্রকাশের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন মজিবুর রহমান মঞ্জু; তারপর তিনি বিকল্প দল গঠনের উদ্যোগ নেন।