ঢাকা, ২৬ আগস্ট মঙ্গলবার, ২০২৫ || ১১ ভাদ্র ১৪৩২
good-food
৫৮৭

আইসিটি সেক্টরে বাড়ছে নারীদের কর্মসংস্থান

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:০৪ ২৯ নভেম্বর ২০২০  

রাফিজা আক্তার এইচএসসি পাশ করেছেন ২০১৮ সালে। এসএসসি ও এইচএসসি দুটো পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছেন। তার ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ার। পছন্দের বিষয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। সেই হিসেবে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তিনি। ভর্তি পরীক্ষার আগে স্কুলের এক প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়। 

 

কুশল বিনিময়ের পর স্যার জানতে চান কোন বিষয়ে রাফিজার আগ্রহ। তখন তিনি ইচ্ছের কথা জানালে শিক্ষক তাকে সাধুবাদ জানান। পাশাপাশি তিনি পরামর্শ দেন যদি তার ইচ্ছে হয় যেন কম্পিউটার সায়েন্সের বিষয়টিও মাথায় রাখে। কারণ, বর্তমান ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে পড়ালেখার মূল্য অনেক। আর এক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে।

 

স্যারের পরামর্শ খুব মনে ধরল রাফিজার। বিশেষ করে নারীরা পিছিয়ে আছে কথাটি শুণে তার আগ্রহ বেড়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিল যেকোনোভাবেই তাকে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স সাবজেক্টে ভর্তি হতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে ফশফন পড়ালেখা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে ভর্তি হলেন স্বপ্নের কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে।

 

৩৯ বছর বয়সী মিরপুর নিবাসী চম্পা বিশ্বাসের গল্পটি কিছুটা ভিন্ন। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ শেষ করার পর চাকরি নেয় এনজিওতে। দু’ বছর চাকরি করার পর বিয়ে হয় তার। বিয়ের পরও চাকরি করছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পর প্রথম সন্তান হলে কিছুটা সমস্যায় পড়ে যান। 

 

তবুও চাকরি করছিলেন চম্পা। এর দুই বছর পর আরো একটি সন্তান হয় তাদের। এরপর দুই বাচ্চাকে সামলানোর জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। এখন বড়টি ক্লাস নাইনে। আর ছোটটি ক্লাস সেভেনে। তারা দু’জন স্কুলে চলে গেলে বাসায় আর তেমন কাজ থাকে না তার। সময়ই যেন কাটতে চায় না।

 

স্বামী বিপ্লবের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে এ নিয়ে আলোচনা করেন চম্পা। এর পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন কম্পিউটারের উপর স্বল্প মেয়াদী কোর্স করবেন আউটসোর্সিংয়ের কাজ করার জন্য। চার-মাস মেয়াদী কোর্স শেষে বাসায় বসেই আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে কাজ পেতে কিছুটা বেগ পেতে হলেও ছয়-সাত মাস পর থেকে তার দম ফেলার সময় থাকে না। 

 

এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় চম্পাকে। শেষে সিদ্ধান্ত নেন বাইরে এ ধরনের কাজ জানেন এমন চারজন নারীকে নিয়োগ দিবেন। এভাবে বর্তমানে তার অধীনে ১১ জন নারী আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে গড়ে প্রতি মাসে চম্পার ৫০,০০০/- টাকা থেকে ৫৫,০০০/- থাকে।

 

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক-এর তথ্যমতে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৯০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সায়েন্স অথবা তথ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে পড়ছে প্রায় ২৫ শতাংশ মেয়ে। ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষ হতে চালিত জরিপে এ তথ্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

 

তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ ছাত্রীর মধ্যে পড়ালেখা শেষে ১৩ শতাংশ আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত হন। আর মাত্র এক শতাংশ নারী আইসিটি সংক্রান্ত কোনও প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করেন।

 

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিওএসএন)-এর মতে, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত আইসিপিসি ঢাকা রাউন্ডের প্রাথমিক বাছাইপর্বে ৯৭৯টি টিমের মধ্যে মাত্র পাঁচটি টিম ছিল, যেখানে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 

জরিপ শেষে (বিওএসএন) নারীদের উৎসাহী করতে বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক প্রচারণা চালায়। ফলপ্রসু ২০১৬ সালে দেখা যায়, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ওই একই প্রতিযোগীতায় ১২৯টি টিমে নারী অংশ নিয়েছেন।

 

বিওএসএন সাধারণ সম্পাদক মুনীর হাসান বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল মেয়েদের আরো বেশি করে আইসিটি সেক্টরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এ লক্ষ্যে আমরা দু’টি প্রজেক্ট হাতে নিই–‘গার্লস ইন আইসিটি’, এবং ‘মিসিং ডটার’। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিতে মেয়ের অংশগ্রহণের সংখ্যা বাড়ানো। আর এসব ক্ষেত্রগুলোতে তারা যেন তাদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে, সেটা দেখা। কারণ, এসব সেক্টরে মেয়েদের অংশগ্রহণ আশানুরুপ নয়।

 

তিনি বলেন, বিওএসএন অনেক উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু ছাত্রীদের উৎসাহ দিতেই আমাদের এতসব প্রচারণা চালাতে হয়েছে।

 

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১.২ মিলিয়ন চাকরি তৈরি হয়। আর এসব চাকরির অধিকাংশই ছেলেদের দখলে থাকে।

 

সম্প্রতি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট পরামর্শ দিয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে চাকরির ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বর্তমানের চেয়ে আরো বেশি পরিমাণে বাড়াতে হবে।

 

পুরুষদের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ যদি ৩৩.৭ শতাংশ হতে বাড়িয়ে ৮২ শতাংশ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথও ১.৬ শতাংশ বেড়ে যাবে।

 

এদিকে বর্তমান সরকারও আইসিটি সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। আইটি সেক্টরে ১০ হাজারেরও বেশি দক্ষ নারী জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের আর্থিক সহযোগীতায় পরিচালিত লিভার্জিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট এন্ড গভর্নেন্স (এলআইসিটি) প্রোজেক্টের অধীনে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী যাতে অংশগ্রহণ করে সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

 

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ডিভিশনের অধীনে এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) উদ্যোগে পরিচালিত এ এলআইসিটি প্রোজেক্ট চালু হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৪,০০০ নারী ও পুরুষকে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রশিক্ষিত ১০,০০০ নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।

 

বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারহানা এ রহমান বলেন, অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি নারীর কর্ম ক্ষেত্রের জন্য অনেক বেশি উপযোগী।

 

তিনি বলেন, যেসব নারীরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা এ সেক্টরে আসতে পারেন। এ সেক্টরে কাজের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে।