ঢাকা, ২৯ মার্চ শুক্রবার, ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০
good-food
১২১৯

অভূতপূর্ব দৃশ্য

পাখির অভয়াশ্রম বাঘা খোর্দ্দ বাউসার আমবাগান

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:১০ ১ নভেম্বর ২০১৯  

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রাম। এ গ্রামে রয়েছে অসংখ্য আমগাছ। এর মধ্যে প্রায় ৫০টি গাছে বাচ্চা ফোটানোর জন্য বাসা বেঁধেছে দেশি পাখি — শামুকখোল। দুয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা পাখিগুলো উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। 
গাছ মালিকেরা জানিয়েছেন, তারা ভাগ্যবান। কারণ, বাঘায় অনেক আমবাগান, অসংখ্য গাছ। কিন্তু সবার গাছে বাসা বাঁধে না পাখি। খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের কয়েকজনের গাছে বাসা বেঁধেছে।


এলাকার লোকজন বলছেন এই এলাকায় পাঁচ বছর ধরে শামুকখোল পাখির আগমন  দেখছি। এ বছর মঞ্জুর রহমান মুকুলের ২৫টি, শফিকুল ইসলামের ৭টি, শফিকুল ইসলাম নান্টুর ৫টি ও সানারুউদ্দিনের ৫টি গাছে শামুকখোল পাখির বাসা দেখা গেছে। এর আগের বছর দুইশ’ গজ দূরে এই পাখিগুলোকে দেখেছি। কিন্তু এবার সেখানকার গাছগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পাখিগুলো নতুন করে চারজন ব্যক্তির বড় বড় আমগাছকে বাসার বাঁধার জন্য বেছে নিয়েছে।

খোর্দ্দ বাউসা গ্রামবাসী জানাচ্ছে, বাগানে কয়েক হাজার পাখির বাসা রয়েছে। সব বাসাতেই বাচ্চা রয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদফতর থেকে আমাদের কয়েকজনকে বলা হয়েছিল। আমরা সে মোতাবেক পাখির বাসাগুলো ভেঙে না ফেলার জন্য বাগান মালিকদের কাছ থেকে ১৫ দিনের সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। তাদের আপত্তি ছিল—গাছগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তো মহামান্য আদালত পাখির বাচ্চাগুলো রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছেন। আমরা গ্রামবাসী সৌভাগ্যবান যে, আমাদের এলাকায় পাখিগুলো এসেছে। আর তাদের আমরা রক্ষা করতে পেরেছি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পাখি বিশেষজ্ঞ আমিনুজ্জামান মো. সালেহ্ রেজা বলেন, রাজশাহী জেলায় অনেক গাছ আছে। কিন্তু জেলার কয়েক জায়গার গাছকে বাসা বাঁধার জন্য বেছে নেয় শামুকখোল, নিশিবক, পানকৌড়ি। এরমধ্যে রয়েছে বাঘার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের বেশ কয়েকটি আমগাছ। শামুকখোল জুন-জুলাই থেকে ডিম দেওয়ার জন্য বাসা বাঁধে। আর এখন (অক্টোবর-নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ) তাদের প্রজনন সময় শেষ হয়ে যাবে। তারপর পাখিগুলো সেখানে থাকবে না। তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ সময় তাদের তৈরি করা বাসা ভেঙে দিলে ভবিষ্যতে এই গাছগুলোতে আর বাসা বাঁধবে না পাখিগুলো। এজন্য বাচ্চাগুলো উড়ে যাওয়ার পরও তাদের তৈরি করা বাসা ভেঙে ফেলা উচিত নয়। তবে যেসব এলাকায় পাখিগুলো বাসা বাঁধে, সেখানকার গাছগুলোতে ফলন একটু কম হয়। তবে ক্ষতির চেয়ে পাখিগুলো মানুষের উপকারও কম করে না। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের একটু নজর দেওয়া উচিত।

পাখিদের উপকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শামুকখোল পাখিটা ধানক্ষেতের শামুক খেয়ে পরোক্ষভাবে আমাদের উপকার করে। এরকম অনেক পাখি আছে; যা আমাদের উপকারে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শালিক পাখি ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকামকড় খেয়ে ফেলায় আমাদের সেগুলোতে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না।


সালেহ্ রেজা বলেন, শামুকখোল বাচ্চা ফোটানোর জন্য বাঘার খোর্দ্দগ্রাম বেছে নিলেও তারা কিন্তু সারা দিন বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করে একবার ঠাঁই নেয় পুঠিয়া উপজেলার পচামাড়িয়া এলাকায়। এছাড়া, আমাদের ক্যাম্পাসে তাপসী রাবিয়া হল ও খালেদা জিয়া হলের মাঝখানে নিশিবক ও পানকৌড়ি মার্চ মাস থেকে ডিম পাড়ার জন্য আসে। এবারও এসেছিল। তাদেরও এখন শেষ সময়। এখান থেকে উড়ে যাবে। নগরীর রাজশাহী জেলখানার পেছনে শামুকখোল পাখিগুলো অন্য বছরগুলোতে বেশি দেখা গেছে। কিন্তু এবার সেখানে কম। কয়েক মাস আগে সেখানে গাছ কাটা হয়েছিল। হয়তো পাখিগুলো জায়গাটাকে এবার তেমন নিরাপদ ভাবেনি। গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট এলাকার পাশে একটি গ্রামে গোদক, নিশিবক, পানকৌড়ি পাখি মার্চ মাসে ডিম পাড়ার জন্য বাসা তৈরি করে। এ এলাকার মানুষ আবার খুব পাখিপ্রেমী। তাদের গাছের একটু ক্ষতি হলেও সেটা নিয়ে তারা ভাবে না। বরং তাদের সন্তানদের পাখিগুলোর বিষয়ে ভালো ধারণা দিয়ে না তাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেয়।

বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিন রেজা বলেন, বুধবার (৩০ অক্টোবর) পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট  তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সে কমিটি বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে তদন্ত করে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে যতদিন পাখি থাকবে, তাদের কোনোভাবে ডিস্টার্ব করা যাবে না। সেইসঙ্গে বাগান মালিকদের ক্ষতির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সবাই খুব আন্তরিকভাবে কাজ করছি। এছাড়া, কৃষি মন্ত্রণালয় বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা ভিজিটও করবে। এই এলাকাকে পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হবে।

রাজশাহীর র‌্যাব-৫ অধিনায়ক মাহ্ফুজুর রহমান বলেন, পাখির বাসা তৈরি করার জন্য আমগাছের বড় ডালগুলো ভেঙে যাচ্ছে, পাখির মলমূত্র ও বাসার খড়গুলো নিচে পড়ে বাগান অপরিষ্কার হয়ে যায়—এমন অভিযোগ করেছেন কিছু বাগান মালিক। তবে পাখির বাসা না ভেঙে তা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে। আমরা পাখিগুলোর দায়িত্ব নিয়েছি। পাখির অভয়াশ্রম ধরে রাখতে এবং অতিথি পাখি শিকার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অতিথি পাখি নিধনের খবর পেলে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে এ গ্রামে পাখির বাসা ভাঙা যাবে না মর্মে, হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ওই এলাকা কেন অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেন।