ঢাকা, ০৩ মে শনিবার, ২০২৫ || ২০ বৈশাখ ১৪৩২
good-food
২৯২৭

বাল্য বিয়ে বন্ধে যা করলেন শিক্ষক

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:০৫ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

১৫ বছর বয়সী সুমাইয়া নিয়মিত স্কুলে যায়। পড়ালেখায়ও খুব ভালো। আবার হাসিঠাট্টায় ক্লাসের সবাইকে মাতিয়ে রাখে সে। উচ্ছ্বল মেয়েটি হঠাৎ করেই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। প্রথম দুদিন সবাই ভাবছিল হয়তো অসুস্থ। কিন্তু আর তিন দিন যাওয়ার পর ক্লাস শিক্ষক মনস্থির করেন তিনি নিজে সুমাইয়ার বাড়ীতে যাবেন।

স্কুল ছুটির পর শিক্ষক ফাহাদ ইসলাম রওনা দেন। বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান সেখানে চলছে বিয়ের আয়োজন। সুমাইয়ার বাবা জানার পর খুব আদর-আপ্যায়ন করেই বসতে দেন শিক্ষককে। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, বুঝলেন মাস্টার সাব, ছেলে ইতালি থাকে। তাদের সুমাইয়াকে খুব পছন্দ। ছেলে দেশে আসল কয়েক দিন আগে। আবার দুমাস পরেই চলে যাবে। তাদের পীড়াপিড়িতে রাজি হয়ে গেলাম। আসছে পরশু বিয়ে। শিক্ষক ফাহাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।

সুমাইয়া রাজী কি-না জানতে চান ফাহাদ। মেয়ের বাবা সে কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়েই তার জন্য চা-নাস্তার কথা বলেই উঠে পড়েন। তখনই ফাহাদ বুঝে যান বিয়েতে সুমাইয়ার মত নেই। আর সে রাজী হবেই বা কেন? তার তো এখন বিয়ের বয়স নয়।

কিন্তু এখন যদি সুমাইয়ার বাবাকে কিছু বলতে যান তবে তা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর তাই চুপচাপ নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়েন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন কালকের মধ্যেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাতে হবে যেকোনো উপায়ে। রাতেই কথা বলে নেন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। তিনিও উৎসাহ দেন। দরকার হলে যাবেন ফাহাদের সঙ্গে।

পরদিন ফাহাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে দেখা করে সবিস্তারে সব বলেন। তিনি আশ্বাস দেন বিয়ের দিন গিয়েই হাতেনাতে সবাইকে ধরে ব্যবস্থা নেয়ার। পরদিন বরযাত্রী ঢোকার ১০ মিনিট পরই পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বিয়ে বাড়ীতে উপস্থিত হন ইউএনও। দুপক্ষের অভিভাবকদের ডেকে বিয়ে বন্ধ করার নির্দেশ দেন তিনি। অন্যথায় জড়িতদের গ্রেফতার করার হুমকিও দেন। প্রথমে মেয়ের বাবা কিছুটা রেগে গেলেও আত্মীয়-স্বজনের চাপাচাপিতে তিনিও মেনে নেন বিয়ে বন্ধ রাখার বিষয়টি।

সূত্র মতে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের শেষের দিকে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। ফলে বাল্যবিয়ে অনেকাংশেই কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু তাদের মতে, এটাও সত্যি যে, শহরে বাল্যবিয়ের হার কমলেও এখনো গ্রাম এলাকায় বিশেষ করে গরীব অধ্যুষিত এলাকায় আনুপাতিক হারে কমেনি। এসব এলাকায় ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের। যদিও আইন অনুযায়ী, মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর আর ছেলেদের ২১ বছর।

মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মনোয়ারা হক বলেন, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধের জন্য বর্তমান সরকার বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। রয়েছে কঠোর আইনও। তারপরও অনেকে পরিবারই বাল্যবিয়ে দিয়ে চলেছে।

তিনি বলেন, অনেক এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পুলিশ অথবা সরকারের অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তারা খবর পেলে বাল্যবিয়ে বন্ধের ব্যাপারে এগিয়ে আসছেন। ফলে বাল্যবিয়ের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অথচ বিগত ৩০ বছর আগেও হার ছিল প্রায় ৭৫ শতাংশ।

এডভোকেট মনোয়ারার মতে, বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি। গ্রামে কিছু পরিবার রয়েছে যাদের মেয়ের বয়স ১১-১২ পেরোলেই তাদের মনে হয় মেয়ে বড় হয়ে গেছে। এখন বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। এ ধরনের ব্যাধি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।

এছাড়া রয়েছে স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা। স্কুলে বা এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যেতে গেলেই তাদের পাল্লায় পড়তে হয় মেয়েদের। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় স্কুলে যাওয়ার সময়। স্কুলে যাওয়ার পথে বিভিন্ন খারাপ মন্তব্যের পাশাপাশি আবার অনেকে মেয়েদের শারিরীকভাবে নির্যাতনও করে। আর অনেক বাবা-মা বা তাদের পরিবার মেয়েদের বিয়ে দিয়ে এসব থেকে নিস্তার পেতে চায়।

তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান অংশীদার। আর এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ- নারীর ক্ষমতায়ন। তবে ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সব অভিভাবকদের এবং তাদের সন্তানদের সচেতন করে তুলতে হবে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে।