ঢাকা, ০৮ অক্টোবর মঙ্গলবার, ২০২৪ || ২৩ আশ্বিন ১৪৩১
good-food
২৮৮

যে স্মৃতি গৌরবের, যে স্মৃতি অশ্রুর

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:১৪ ১০ মে ২০২৪  

১. জাতি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান স্কোয়াড্রন লিডার আসীম জাওয়াদকে হারাল। বিমানটি যখন চট্রগ্রামের উপর দিয়ে চালানো হচ্ছিল তখন অগ্নিকান্ড লাগে। জাওয়াদ এবং তাঁর সহযোগী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিমানটিকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নিয়ে আসেন। ফলে আগুন লাগা বিমানটি নদীতে ফেলতে সক্ষম হন এই বীর। অগ্নিদগ্ধ বিমানটি জনপদে পড়লে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারতো, সেটি বাঁচিয়ে শহীদের খাতায় নাম লেখালেন স্কোয়াড্রন লিডার জাওয়াদ। আই হ্যাট অফ উইথ বেস্ট অব অনার ,আই স্যালুট ইউ উইথ টিয়ার।

 

২. ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার আগেই জেনারেল ডিউটি পাইলটের নির্বাচনী পরীক্ষায় শর্ত সাপেক্ষে উত্তীর্ণ হই। শর্ত ছিল ইন্টারমিডিয়েটে নূন্যতম ২য় বিভাগ পেতে হবে। ফল বের হল। রেজাল্ট তার চেয়ে অনেক ভালো হল। এই সময় আমাদের এক নিকটাত্মীয় ,পদবীতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট প্রশিক্ষণের সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই মৃত্যু আমার বাবা -মা এবং মৃত অফিসারের নিকট আত্মীয়দের মনে এতই গভীর রেখাপাত করে যে, আমার বিমান বাহিনীতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে আমাকে নাম লেখাতে হয়।

 

৩. সেনাবাহিনীতে চাকরির মাত্র এক বছরের মাথায় বিমান বাহিনীতে প্রেষণে এডজুটেন্ট এরো মেডিকেল ইনস্টিটিউটে পোস্টিং হয়। আমার ক্যাপ্টেন পদবী বদলে হয়ে যায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। কম্ব্যাট পোশাকের বদলে "পাখির " পোশাক পরা শুরু হল। হেলিকপ্টার এবং পরিবহন বিমানের পাইলট ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্ব'র সাথে যুদ্ধ বিমানের পাইলটদেরকে বিভিন্ন সংবেদনশীল সবাস্থ্য বিষয়ক পাঠদান শুরু করি। এছাড়াও প্রতিদিন ফ্লাই করার আগে পাইলটদের খুব ভালো করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতাম। এই প্রক্রিয়াকে প্রিফ্লাইট মেডিকেল চেকআপ বলা হতো। সামান্য কোনও ব্যত্যয় হলে তাঁরা ফ্লাই করার অনুপযুক্ত হতেন।

 

৪. সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্নেহ বর্ষণের ব্যপারে বিধাতা আমার প্রতি অকৃপণ ছিলেন। খোদ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ মাত্র দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমাকে স্নেহের খাতায় বন্দী করেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অবস্থায় আমাকে "ডেমি অফিসিয়াল লেটার " প্রদান করেন। পরবর্তীতে প্রেষণ শেষে সামরিক বাহিনীতে ফিরে এলেও স্নেহের সেই ফল্গু ধারা প্রবহমান থাকে। আমার ক্যাপ্টেন এবং মেজর পদবীতে চাকরিকালীন তিনি আরও দুবার "ডেমি অফিসিয়াল লেটার" প্রদান করেন। একজন সৈনিকের জীবনে এই গৌরব খুব অল্প ক'জনার ভাগ্যে জোটে।

 

৫.আমার কলেজের নিকটতম বন্ধু মহসীন বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। মেধাবী এই অফিসার 'সোর্ড অব অনার"সহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কারে ঋদ্ধ হন। আমাদের অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার মহসিন যুদ্ধ বিমান চালানোর সময় দুর্ঘটনায় তেজগাঁও পি এস সি অফিসের পাশে অগ্নিদগ্ধ বিমানসহ মুখ থুবড়ে পড়েন। কাঠ কয়লা পোড়ালে যেমন আকার হয় তেমন আকৃতিতে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। বিমান বাহিনী বেগম মহসীনকে বিশেষ সন্মানের সাথে এয়ারফোর্স অফিসার্স কোয়ার্টারে রাখেন। আমরা অপরাধী মুখ নিয়ে সপরিবারে ভাবীকে দেখতে যেতাম। উনার অশ্রুসিক্ত চোখে আমরা চোখ রাখতে পারতাম না।

 

৬. এয়ারফোর্স অফিসার মেসে থাকার সময় সান্ধ্যকালীন আড্ডার নিত্যসাথী আরো দুজন পাইলটের কাঠকয়লা লাশ এই দুই পোড়া চোখ দিয়ে দেখার বেদনা আজও আমার দু:স্বপ্নের সাথী।

৭. স্কোয়াড্রন লিডার জাওয়াদের মৃত্যু আমার কাছে পাথরের মতো ভারী। তাঁর প্রেমময়ী স্ত্রী, স্নেহময়ী মা, আদরের সন্তানেরা এই মৃত্যুর ভার একজনমে কি ভাবে বইবে? আমার অসংখ্য প্রিয়জন হারার বেদনার লিস্ট বড় বড় হতে আর কত বড় হবে?

 

লেখক: মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ 
ক্লাসিফাইড স্পেশালিস্ট 
বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস।