ঢাকা, ৩১ জুলাই বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২
good-food
১১৯

বিমান নয়, শিশুদের কফিন উড়ছিল আকাশে!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:০৫ ২২ জুলাই ২০২৫  

রাজধানী ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে গতকাল যে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি ঘটেছে, তা শুধু একটি বিমান দুর্ঘটনা নয়—এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা এবং দায়হীনতার করুন চিত্র। একটি প্রশিক্ষণ বিমান স্কুলের ওপর বিধ্বস্ত হয়ে অনেক নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। দেশ শোকে স্তব্ধ, হৃদয় বিদীর্ণ। কিন্তু এ শোকের ছায়া ছাপিয়ে আজ প্রশ্ন উঠছে

 

—এই দুর্ঘটনা কি এড়ানো যেত না?
প্রশিক্ষণের আড়ালে প্রাণহানি হয়েছে, এটা দুর্ঘটনা নয়, রাষ্ট্রের ভয়ংকর ব্যর্থতা। মনে হচ্ছে বিমান নয়, শিশুদের কফিন উড়ছিল—এই ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।

 

মূলত: আকাশে নয়, নীতির পতনে ভেঙে পড়েছে বিমান। এটা কোনও দুর্ঘটনা নয়, না কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ—শুধুই এক নিষ্ঠুর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকেই স্বরণ করিয়ে দেয়। শিশুর রক্তে রঙিন বিমান প্রশিক্ষণ—এই লজ্জায় আমাদের মাথা নুইয়ে পড়ে। যেন মৃত্যুর মেঘে ঘেরা আকাশে উড়ছিল রাষ্ট্রের অবহেলা, আর শিক্ষার মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছিল শিশুদের রক্তকান্নার রোল।

 

কেন এমনটি হবে? কেন জনবহুল নগরে বিমান প্রশিক্ষণ দিতে হবে? এসবের উত্তর রক্তেই মাখা,থাকবে, কেউ উত্তর দিবেন না জানি। কেননা, বাংলাদেশে জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চালানোর বিপজ্জনক প্রবণতা দীর্ঘদিনের। অথচ এই অনিয়ন্ত্রিত, অদূরদর্শী নীতির পরিণতি এত ভয়াবহ হবে—তা হয়তো কল্পনাতেও ছিল না।

 

দুর্ঘটনার সময় বিমানটি রাজধানীর অদূরে পূর্বাচলে প্রশিক্ষণ চালাচ্ছিল। এলাকাটি এখন ঘনবসতিপূর্ণ, স্কুল-কলেজ-অফিসে পরিপূর্ণ, শিশুদের চলাচলের অন্যতম কেন্দ্র। সেখানে কীভাবে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট চালানো হয়—এই প্রশ্নের উত্তর আজ জরুরি হয়ে উঠেছে।

 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়—প্রশিক্ষণ বিমান চালানোর জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল, ন্যূনতম নিরাপত্তা কাঠামো এবং জনবসতি মুক্ত এলাকা বেছে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালিত হয় Arizona বা Texas-এর মরুভূমিতে, সেখানে জনবসতি নেই, দুর্ঘটনা হলেও বড় প্রাণহানির সম্ভাবনা কম। ব্রিটেন বা ভারতেও নির্ধারিত “training airspace” বা প্রশিক্ষণ এলাকার বাইরে সাধারণত ফ্লাইট দেওয়া হয় না।

 

অথচ বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানীর আকাশে প্রায়ই দেখা যায় ছোট প্রশিক্ষণ বিমান উড়তে—এ যেন উড়ন্ত দুর্ঘটনার প্রহর গোনা। পূর্বাচল এলাকায় স্কুল, হাউজিং প্রজেক্ট, কমার্শিয়াল জোন—সবকিছুর মাঝখানে প্রশিক্ষণ বিমান চলা শুধু অবিবেচনাপ্রসূত নয়, বরং চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।

 

এই দুর্ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে অতীতে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ ও সামরিক ফ্লাইট দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ২০১০ সালে বরিশালে, ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে, ২০১৮ সালে টাঙ্গাইলে—প্রতিবারই প্রাণহানি হয়েছে, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, রিপোর্ট জমা পড়েছে, কিন্তু কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ না হলেও পাইলট বা ট্রেইনি প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এবারের মতো শিশুদের বড় প্রাণহানি এই প্রথম।

 

২০২৫ সালের ২১ জুলাইয়ের দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় আমরা কতটা অগোছালো, আর আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কতটা উদাসীন।

 

এই প্রেক্ষাপটে সরকার যদি যথাযথ তদন্ত করে কেবল রিপোর্ট দিয়ে দায় শেষ করে, তবে সেটা হবে দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড। কারণ, যারা জানতেন—এই এলাকায় বিমান চালানো অনিরাপদ, যারা অনুমোদন দিয়েছেন, যারা নজরদারি করেননি—তাদের প্রত্যেকের দায় আছে। শুধু পাইলটের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দায় এড়ানো যাবে না।

 

এই দুর্ঘটনার দায় বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB), প্রতিরক্ষা বাহিনী, ফ্লাইট স্কুল এবং প্রশাসনের যৌথ। এ দায়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে মন্ত্রণালয়কে, অবশ্যই।

 

সরকার ইতিমধ্যে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাতে সান্ত্বনা হয়তো কিছুটা মিলবে, কিন্তু উত্তর মিলবে না। উত্তর হচ্ছে—এই শিশুরা যে রক্ত দিয়ে আমাদের অবহেলার মূল্য দিল, ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো প্রাণ না দেয়, তার জন্য কী করা হচ্ছে?

 

এখানে সময় এসেছে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার। জনবসতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চালানো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দেশব্যাপী নির্দিষ্ট “training zone” চিহ্নিত করে সেখানে প্রশিক্ষণ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের ওপর কঠোর নজরদারি ও অনুমোদনের নিয়মকানুন পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

 

সবার আগে, দুর্ঘটনার স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সময়সীমাবদ্ধ তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের প্রকাশ্যে চিহ্নিত করতে হবে। একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যেখানে প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনার নিরাপত্তা, সময়, এলাকা ও আকাশপথ নির্দিষ্ট থাকবে।
এই দুর্ঘটনা রাষ্ট্রের একটি ভয়ংকর ব্যর্থতা—এটা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এখানে মানবসৃষ্ট ভুল, অবহেলা এবং নীতির অভাবই প্রাণ নিয়েছে এতগুলো শিশুর।

 

আমরা যদি এই ঘটনার যথাযথ বিশ্লেষণ না করি, উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেই, তবে এই শিশুদের আত্মা হয়তো আমাদের ক্ষমা করবে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু দাফনের খরচ দেওয়া নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করা। সেই শিক্ষা নিতেই আজ জরুরি একটি কঠিন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা—প্রশিক্ষণ বিমানের নামে আর কত শিশুর লাশ আমাদের দরকার?

 

লেখক: মাহামুদুল হক
শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি), রংপুর।