ঢাকা, ১৯ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০২৫ || ৫ পৌষ ১৪৩২
good-food

ওসমান হাদি: জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের ৭ দিন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:১৫ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫  

না ফেরার দেশে চলে গেলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক অকুতোভয় যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি। আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রচারে নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রচারণার মাঝপথেই ১২ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে গুরুতর আহত হন। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত সাত দিনে তাঁর জীবন মৃত্যু সংগ্রামসহ যে সব ঘটনা ঘটেছে নিচে তা তুলে ধরা হলো।

১২ ডিসেম্বর (শুক্রবার): হামলা চালানো হয়

১২ ডিসেম্বর ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন ওসমান হাদি। জুমার নামাজের পর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে ব্যাটারি চালিত রিকশায় ফকিরাপুল থেকে বিজয়নগরের দিকে যাচ্ছিলেন হাদি। তাঁর সঙ্গে ছিল আরেকজন সহকর্মী। এসময় হাদিকে বহনকারী রিকশাটিকে পিছন থেকে একটি মোটরসাইকেল অনুসরণ করতে থাকে। দুপুর ২টা ২৪ মিনিটে চলন্ত রিকশার পেছন থেকে মোটরসাইকেলের আরোহী ওসমান হাদিকে গুলি করেন। গুলি চালিয়েই হামলাকারীরা দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহতাবস্থায় হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। 

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো আসাদুজ্জামান জানান, গুলি তাঁর ডান কান পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার বাম দিক ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। তাঁকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেওয়া হয়েছে। নিউরোসার্জনদের একটি দল প্রাথমিক অস্ত্রোপচার করে। সন্ধ্যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়।

ঘটনার পর রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী মিছিল শুরু হয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এই হামলা হওয়ায় রাজনৈতিক নেতারা কঠোর নিন্দা জানান। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দেন। ঘটনার পর পুলিশ, র‍্যাব, সিআইডি ও পিবিআইয়ের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে হামলাকারীদের শনাক্তে কাজ শুরু করেন।

১৩ ডিসেম্বর (শনিবার): সন্দেহভাজন শনাক্ত

হামলার পরদিন ঢাকা মহানগর পুলিশ ও র‍্যাব জানায়, হামলাকারীদের মধ্যে একজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাঁরা জানান, গুলি চালানো ব্যক্তির নাম ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান। তিনি একসময় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত বছর অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। পরে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন।

সীমান্ত, সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরে তাঁর তথ্য পাঠানো হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। একই সঙ্গে তিনি জানান, অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ চালু হবে।

অন্যদিকে, হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা হাদীর শারীরিক অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব জানান, তার ‘ইন্টারনাল রেসপন্স’ থাকলেও তিনি বিপদমুক্ত নন।

সেই দিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠকে হামলা নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রতিবাদ সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৪ ডিসেম্বর (রবিবার): তদন্ত ও গ্রেপ্তার

এদিন তদন্ত সূত্র জানায়, ঘটনায় জড়িত হিসেবে তিনজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাঁদের মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গুলি চালান ফয়সাল। চালক ছিলেন আলমগীর শেখ। তাঁদের সঙ্গে জাকির নামের আরেকজন ছিলেন। পরিকল্পনা করে এই হামলা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, হামলার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ফয়সাল এবং আলমগীর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।

পুলিশ জানায় তাঁদের সম্ভাব্য অবস্থান চিহ্নিত করে ১৩ ডিসেম্বর রাতেই সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান চালানো হয়। মানব পাচারের অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান দুই বাংলাদেশিকে সীমান্ত পার করিয়েছেন। তাদেরই ফয়সাল ও আলমগীর বলে ধারণা করা হয়। র‍্যাব মোটরসাইকেলের নম্বর সনাক্ত করে মালিক সন্দেহে আবদুল হান্নান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু, বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমাকে আটক করে র‍্যাব। পরে তাঁদের পল্টন থানায় সোপর্দ করা হয়।

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ১৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ জাবের। মামলায় ফয়সালসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য ডিএমপির গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়।

১৫ ডিসেম্বর (সোমবার): উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে

এই দিনে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাদিকে বিমানযোগে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে ভাই এবং দুইজন বাংলাদেশি চিকিৎসক যান। তদন্ত সূত্র জানায়, দুই সন্দেহভাজন ফয়সাল ও আলমগীর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাঁরা ঢাকা থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে যেতে পাঁচ দফা যানবাহন বদলান। মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট বদলে তাঁরা ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে নিয়েছিলেন; ফেলে দিয়েছিলেন মুঠোফোন ও সিম।

পুলিশ জানায়, এই হামলার ঘটনায় মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা, শ্যালক ওয়াহিদ, বান্ধবী মারিয়া, মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে হান্নান এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তার অভিযোগে সঞ্জয় চিসিম ও সিমিরন দিও।

এদিন র‍্যাব জানায়, ফয়সালের সহযোগী মো. কবিরকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার কয়েক দিন আগে ফয়সালের সঙ্গে বাংলামোটরে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়েছিলেন কবির।

এদিন প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের বোনের বাসা থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। সেই ব্যাগের ভেতর থেকে দুটি ম্যাগাজিন ও ১১টি গুলি উদ্ধার করা হয়।

ওসমান হাদির ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মন্তব্য করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বিভিন্ন দল এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বদলীয় সমাবেশ হয় যেখানে বিভিন্ন দলের নেতা অংশ নেন।

১৬ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার): অস্ত্র উদ্ধার ও গ্রেফতার অব্যাহত

ইনকিলাব মঞ্চ জানায় সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর হাদির শারীরিক অবস্থা কখনো স্থিতিশীল আবার কখনো দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁর আরেকটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু সে অবস্থাও তৈরি হয়নি বলে জানানো হয়।

গ্রেপ্তার হুমায়ুন ও ওয়াহিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর সদর উপজেলার তরুয়া এলাকার একটি বিলের ভেতর থেকে ২টি পিস্তল ও ৪১টি গুলি উদ্ধার করে র‍্যাব। এ ছাড়া একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মো. ফয়সল। তিনি ওয়াহিদের বন্ধু। 

এদিন রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‍্যাব জানায়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ফয়সালের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগমকে (৬০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফয়সালকে পালাতে ‘সহায়তাকারী’ নুরুজ্জামানকেও এদিন আটক করা হয়। সব মিলিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ায় নয়ে।

১৭ ডিসেম্বর (বুধবার): অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক

১৭ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান বুধবার দেশটিতে চিকিৎসাধীন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে দেখতে যান।

পরে রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে তিনি জানান, হাদীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে শান্ত থাকতে এবং হাদির জন্য দোয়া করতে বলেন।

১৮ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার): না ফেরার দেশে

এ দিন সকাল থেকেই মানুষের মধ্যে ওসমান হাদিকে নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছিল। তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে দিনভর সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা চলছিল। দিনভর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার পর রাত পৌনে ১০টার দিকে আসে সেই দুঃসংবাদ।

জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ওসমান হাদী। চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়নে থাকা একজন কর্মকর্তা তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজেও ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর জানানো হয়। সিঙ্গাপুর থেকে এই খবর নিশ্চিত হওয়ার পর শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো দেশে।