ঢাকা, ১৯ মার্চ মঙ্গলবার, ২০২৪ || ৫ চৈত্র ১৪৩০
good-food
১৩৬৬

কী খাচ্ছি, খাবার না বিষ ?

ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:১৮ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

মানুষের মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

ভেজাল খাদ্য পণ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি

আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে প্রকাশ, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে। টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। তবে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপি- ও অস্থিমজ্জার। ধীরে ধীরে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণদের কিছুটা দেরিতে।

খাদ্যপণ্য ভেজালের কারণেই দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ।

কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো- পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথাঘোরা, মল পাতলা বা হজম বিঘ্নিত মল, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, ইউরিয়া ও হাইড্রোজ হচ্ছে এক ধরনের ক্ষার। এগুলো পেটে গেলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেপটিন এসিড তৈরি করে যা ক্ষুদামন্দা, খাবারে অরুচি, বৃহদান্ত ও ক্ষুদ্রান্তে প্রদাহসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে।

জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের ডা. আহমদ সাইফুল জব্বার বলেন, মেটাল বেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গণ্ডগোল, ডায়েরিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের এনেসথেশিয়া ডা. মো. মিল্লাত-ই-ইব্রাহীম বলেন, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এ খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্না করার পরও অটুট থাকে।

তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তাহলো অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চরক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি।

মাছ ও সবজিতে ফরমালিন

শুধু ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতেই ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। হাট বাজার ঘুরে কেমিক্যালমুক্ত মাছ মেলে না কোথাও। এর মধ্যেই ক্ষতিকর পিরহানা মাছ, রাক্ষুসে মাগুর, জীবনহানিকর পটকা মাছের দেদার বাজারজাত চলছে। বাধা দেয়ার যেন কেউ নেই। মাঝে মাঝে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঝটিকা অভিযানে বিষাক্ত মাছ জব্দ ও বিনষ্ট করা হয়। কিন্তু মাছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল প্রয়োগ মোটেও বন্ধ করা যাচ্ছে না। সবুজ সবজিতেও ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে অবাধে। পাইকারি আড়তগুলোতে মাছের স্তূপ দিয়ে তার ওপর প্রকাশ্যেই ফরমালিন ছিটানো হতো অথবা স্প্রে করা হতো কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। প্রশাসনের নজরদারির ভয়ে এখন আর আড়তে কেমিক্যাল মেশানোর ঝুঁকি নেয় না কেউ। মাছ আহরণ স্থল থেকেই প্রয়োগ করা হয় ফরমালিন। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছগুলোতে তাজা থাকা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ করা হয়। আর ছোট আকারের মাছগুলো শুধু ফরমালিন মিশ্রিত পানির ড্রামে চুবিয়ে তুললেই চলে।

ব্যবসায়ীরা বাজারে ফরমালিন ব্যবহারের ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাট বাজারের বেশিরভাগ দোকানেই অবাধে ফরমালিন ব্যবহার করতে দেখা যায়। আড়তগুলো ফরমালিন মিশ্রিত বরফ দ্বারা মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করছে অভিনব স্টাইলে। এক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানো পানি দিয়েই বরফের পাটা বানানো হয়। সেই ফরমালিন বরফের মধ্যেই দিনভর চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ। সাধারণ পানি দিয়ে বানানো বরফ পাটাগুলো ধবধবে সাদা থাকে, ফরমালিন বরফ পাটার রঙ থাকে হালকা বাদামি।

বেকারির অস্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য

রাজধানীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে শত শত বেকারি কারখানা। কালি-ঝুলি মাখা প্রতিটি কারখানার ভেতরে-বাইরে কাদাপানি, তরল ময়লা-আবর্জনাযুক্ত নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। আশপাশেই নর্দমা ময়লার স্তূপ। মশা-মাছির ভনভন আর একাধিক কাঁচা-পাকা টয়লেটের অবস্থান। কারখানাগুলো স্থাপিত হয়েছে টিনশেড বিল্ডিংয়ে। বহু পুরনো চালার টিনগুলো স্থানে স্থানে ছিদ্র থাকায় বৃষ্টির পানি অনায়াসেই কারখানা ঘরে ঢুকে। এতে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত হয়ে থাকে মেঝে, কাদাপানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় খাদ্য-সামগ্রীতে, কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা নেই, দম বন্ধ হওয়া গরম থাকে রাত-দিন গরমে ঘামে চুপসানো অবস্থায় খালি গায়ে বেকারি শ্রমিকরা আটা-ময়দা দলিত মথিত করে। সেখানেই তৈরি হয় ব্রেড, বিস্কুট, কেকসহ নানা লোভনীয় খাদ্যপণ্য। অভিযোগ আছে উৎপাদন ব্যয় কমাতে এসব বেকারির খাদ্যপণ্যে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পচা ডিমসহ নিম্নমানের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। কেক ও ব্রেড তৈরির জন্য সেখানে পিপারমেন্ট, সোডা ও ব্রেকিং পাউডার রাখা হয়েছে পাশাপাশি। বেকারির কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ট্যালো, ফ্যাটি এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সটাইল রঙসহ নানা কেমিক্যালও ব্যবহার করতে দেখা যায়। আশপাশের কারখানাগুলোতে দেদার ব্যবহার হচ্ছে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল ও পচা ডিম। বেকারিতে পচা ডিম ব্যবহার যেন সাধারণ বিষয়।

বিষাক্ত এনার্জি ড্রিংক ও জুস

এনার্জি ড্রিংকস বলতে কোনো পণ্যসামগ্রী উৎপাদন বা বাজারজাতের জন্য বিএসটিআই কোনো রকম অনুমোদন দেয় না। তা সত্ত্বেও অনুমোদন পাওয়ার জন্য একটি আবেদনপত্র বিএসটিআই কার্যালয়ে জমা দিয়েই কারখানায় দেদার উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের কেমিক্যাল বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, যে কোনো ড্রিংকস উৎপাদন ও বোতলজাতের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে অটো মেশিনে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্ধারিত ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল উপকরণগুলো ফুটিয়ে নিয়ে তা রিফাইন করার মাধ্যমে সংমিশ্রণ ঘটানো এবং বোতলজাত করা থেকে মুখ লাগানো পর্যন্ত সবকিছুই অটো মেশিনে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু কথিত জুস কারখানাগুলোতে সবকিছুই চালানো হচ্ছে হাতুড়ে পদ্ধতিতে।

মসলায় রঙ, ইট ও কাঠের গুঁড়া

অধিক মুনাফার আশায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মসলায় কাপড়ে ব্যবহৃত বিষাক্ত রঙ, দুগন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া (নিম্নমানের মরিচ) ধানের তুষ, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মটর ডাল ও সুজি ইত্যাদি মেশাচ্ছেন। বাংলাদেশ স্টান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) ও কনজিওমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব) অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। ভেজাল মসলা কিনে ক্রেতারা শুধু প্রতারিতই হচ্ছেন না, এতে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। কারণ ভেজাল মসলায় মেশানো ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভেজাল মসলা উৎপাদনকারী গুঁড়া মরিচের সঙ্গে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মেশাচ্ছেন ইটের গুঁড়া। হলুদে দেয়া হচ্ছে মটর ডাল, ধনিয়ায় সমিলের কাঠের গুঁড়া ও পোস্তদানায় ব্যবহৃত হচ্ছে সুজি। মসলার রঙ আকর্ষণীয় করতে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল রঙ মেশানো হচ্ছে। এর কারণে গুঁড়া মরিচের ঝাল বাড়ে এবং হলুদের রং আরও গাঢ় হয়। মসলার ওজন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ধানের ভুসি। অসাধু চক্র প্রথমে গোপন কারখানায় ভেজাল মসলা উৎপাদন করে। পরে তা প্যাকেটজাত করে খোলাবাজারে সরবরাহ করে। তারা কিছু প্যাকেট ছাড়া, কিছু সাধারণ প্যাকেটে এবং কিছু নামিদামি কোম্পানির লেভেল লাগিয়ে মসলাগুলো বিক্রি করেন।

ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল

বাজারের কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা থেকে শুরু করে আপেল, আঙুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। সাধারণ ফল-মূলের উজ্জ্বল রঙ ক্রেতাদের নজর কাড়ে, সেগুলো বিক্রিও হয় বেশি দামে। তাই অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তর করার জন্য অধিক ক্ষার জাতীয় টেক্সটাইল রঙ ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রি করা মুহূর্ত পর্যন্ত এক একটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়।

ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই ফলমূলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। অন্যদিকে ফলমূল দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করতে ফরমালিনসহ আরও কিছু বিষাক্ত পদার্থের ও ব্যবহার চলে অহরহ। ইথাইলিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগের কারণে ২-৪ দিনের মধ্যেই ফল হলুদ রঙ ধারণ করে। বাস্তবে এসব ফল বাইরে পাকা মনে হলেও এর ভেতরের অংশে অপরিপক্ব থেকেই যায়। পরবর্তীতে সে ফলগুলো খাওয়ার কারণে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল, শুরু হয় নানা অসুখ-বিসুখ। অপরিপক্ব ফলমূলের স্বাদ-গন্ধ, ভিটামিনও অনেক কমে যায়। ফল পাকাতে যে বিপজ্জনক রাসায়নিক পর্দাথটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় তার নাম কার্বাইড।

বাগান থেকে আম পাড়ার পর কমপক্ষে তিনবার বিভিন্ন রাসয়নিক দ্রব্য স্প্রে করা হয়। রাতে গুদাম বন্ধ করার আগে ফরমালিন স্প্রে করা হচ্ছে। ফলে ভোরে আমে ফরমালিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। তা ছাড়া অতিরিক্ত তাপে ক্যালসিয়াম র্কাবাইড মেশানে আম রাখলে তা ক্যালসিয়াম সায়নাইডে পরিণত হতে পারে। যা অত্যন্ত মারাত্মক বিষ। কার্বোহাইড্রেটযুক্ত ফল চেনা অতটা কঠিন কিছু নয়, প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলে সমান (ইউনিফরম) রঙ হবে না, বোঁটার অংশে লালছে আভা রঙ হবে এবং ফল মিষ্টি হবে। কৃত্রিমভাবে পাকানো ফলে সব অংশে সমান রঙ হবে এবং ফলের ভেতরে চামড়ার অংশে একটু তিতা হবে। তাছাড়া ফলের এক অংশে টক অন্য অংশে মিষ্টি হয়।

মুড়িতে ইউরিয়া

এখানেও ঢুকে পড়েছে ভেজালের বিষবাষ্প। লবণের বদলে মেশানো হচ্ছে সেই ইউরিয়া। কারখানায় ভাজা মুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আড়তদারদের প্ররোচনায় গ্রামের সহজ সরল বউ-ঝিরাও মুড়িতে মেশাচ্ছেন এই বিষ। প্রতিযোগিতার বাজারে মুড়িকে লম্বা, সাদা, ফাঁপানো ও আকর্ষণীয় করতে মুড়ি বেপারি এবং আড়তদাররা শ্রমিকদের সার সরবরাহ করছেন। তাদের প্ররোচনায় না বুঝে ঘরে ঘরে মুড়ি শ্রমিকরা লবণের বদলে চালে ইউরিয়া মিশিয়ে মুড়ি তৈরি করছেন। মুড়ি ভাজার চালের সঙ্গে বস্তায় বস্তায় ইউরিয়া। ইউরিয়া মিশ্রিত মুড়ির কুফলও জানেন না মুড়ি শ্রমিকরা। এক কেজি ইউরিয়ায় প্রায় ১৬০ কেজি মুড়ি ভাজা হয়। লবণের দাম বেশি হওয়ায় আর বেপারি আড়তদাররাও খুশি হওয়ায় চালে এ ইউরিয়া মিশিয়েই এখন মুড়ি ভাজা হচ্ছে। এসব সারের ক্রেতা শুধু মুড়ি বেপারি, আড়তদার ও শ্রমিকরা। বারোপোতায় এখন শুধু বিআর১১ ও ব্রি ধান২৮ ধানে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। দুই-চার বছর আগেও এখানে ঘরে ঘরে আউশ ধানের মুড়ি ভাজা হতো। ব্যবসায়ী আজিজুল জানান, বেপারি-আড়তদাররা যাচ্ছে তাই ধান কিনে দিচ্ছেন শ্রমিকদের। দরিদ্র শ্রমিকরা চালে ইউরিয়া মিশিয়ে সেই ধান থেকেই মুড়ি তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মুড়িতে ইউরিয়ার সঙ্গে হাইড্রোজও মেশানো হচ্ছে। তা চিনার উপায় হলো এ ধরনের মুড়ির শরীরে অসংখ্য ছিদ্র থাকে, দেখতে খুব সাদা রঙের হয়। স্বাদ পানসে হয়ে যায়।

দূষিত পানি বোতলে

ফলমূল, দুধ, মাছে ফলমালিন-কার্বাইডের বিষ, অন্যান্য খাদ্যপণ্যও ভেজালমুক্ত রাখা যায়নি। এমকি জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি পানি পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর ডোবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই বিশুদ্ধ মিনারেল পানি বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্লাস্টিক জার (বড় আকারের বোতল) ভরা পানি বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতে পৌঁছানোর মাধ্যমেও জমে উঠেছে দূষিত পানির রমরমা ব্যবসা। জীবন রক্ষাকারী পানি নিয়ে মরণঘাতী খেলা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের পরীক্ষাগারে বোতলজাত পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অতি নি¤œমানের পানি হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। মাত্র ১৯টি কোম্পানি অনুমোদন নিলেও দেশজুড়ে বোতলজাত পানির জার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। এর মধ্যে একটিরও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি গামছায় ছেকে বোতলে ভরে বাণিজ্য করা হচ্ছে।

দুধ নয় পুরোটাই নকল

শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেন না এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, এবার নকল দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তারা। এ দুধ সংগ্রহে কোনো গাভীর প্রয়োজন পড়ে না, কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয় না গবাদি পশুর খামারও। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হচ্ছে এমন বিষ। পরে খাঁটি দুধ হিসেবে তা চালান হয়ে আসছে রাজধানীতে। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন।

জানা গেছে, পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে সহজেই নকল দুধ তৈরি করা যায়। তবে প্রয়োজন পড়ে আরও কয়েক পদের রাসায়নিক পাউডারের। যা পানিতে মিশিয়ে একেবারে সাদা দুধের আকার ধারণ করে। খালি চোখে তা ধরা অসম্ভব। এর শিকার হচ্ছেন পূর্ণ বয়স্ক থেকে শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি নকল দুধ পানে পেটের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর প্রভাব পরতে পারে কিডনি বা লিভারের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও। নকল দুধ তৈরির কারখানাগুলোতে ছানার ফেলনা পানি, খাবার পানি, থাইসোডা, পার অক্সাইড, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কাটিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস দেয়া হয়।

ধলেশ্বরী ঘাট থেকে নকল দুধের চালান পাঠানো হয় দুটি নামিদামি ডেইরি প্রজেক্টে। পরে ওই প্রজেক্টের প্লাস্টিক মোড়কে প্যাকেটজাত দুধ হিসেবে বাজারে বাজারে পৌঁছে যায়। আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের ডা. এস কে রায় জানান, রাসায়নিক মিশ্রিত এসব নকল দুধ পানের কারণে মানবদেহে ডায়রিয়া, জটিল পেটের পীড়া, কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্ত হচেছ প্রতিনিয়ত। শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরো মারাত্মক। বাজারে চলমান একমাত্র হোমমেড রসগোল্লা নামের পণ্যটি আগাগোড়াই ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাবার আদালতে মামলা রজু করা হয়েছে।

রুখে দাঁড়ান খাবারে রাসায়নিক সন্ত্রাস

খাবারে ভেজাল আজ কোনো গোপনীয় ব্যাপার নয়। সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যেও বৈধতা পেয়েছে। মহাসমারোহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্য মরণব্যাধির নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ মেশানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা অনেকে জানিই না ফরমালিন, কার্বাইড কী? কী এর অপকারিতা? কী ধরনের রোগ হতে পারে রাসয়নিক পদার্থগুলোর প্রভাবে? সবচেয়ে আলোচিত ফরমালিন। এটা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা ফল, মাছ ও মাংসে মিশিয়ে পচন রোধ করা হয়। মূলত জীবাণুনাশক ও প্রাণীর মরদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয় এটি। ব্যাকটেরিয়া নাশক হওয়ায় কসমেটিক তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা হয়। বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছেই বরফের সঙ্গে বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায়, ফরমালিন ব্যবহারে মানুষের দেহে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা যেমন- পাকস্থলীর ক্যান্সার, দৈহিক বিকলাঙ্গতা এমনকি প্রাণহানিও ঘটাতে পারে। মাত্রা বেশি থাকলে শরীর অবশ হয়ে যেতে পারে। বৃক্ক, যকৃৎ, ফুলকা, পাকস্থলী ও লিভার সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিন্তু কীভাবে চিনব মাছে ফরমালিন আছে?

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাছের দেহ শক্ত হয়ে যায়, যেন আমরা কেনার সময় ভাবি মাছ তাজা আছে। আঁশ উজ্জ্বল না হয়ে ধূসর রঙের হয়ে যায়, ফুলকাও ধূসর রঙের হয়। এসব দেখে মাছ কিনলে ফরমালিনযুক্ত মাছ পাওয়া যেতে পারে। ফরমালিন ব্যবহার মাছে সাধারণত মাছি বসে না। গ্রীষ্মকালীন প্রায় সব ফলে এখন ফরমালিন ও কার্বাইড অথবা অন্য কোনো রাসায়নিক স্প্রে করা হচেছ। এ সন্ত্রাস থেকে রেহাই পেতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উন্নত প্যাকেজিং প্লান্ট হাতে নেয়া যায়। যাতে কিছু দিন ফল সংরক্ষণ করা যায়। আলট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে গ্রীষ্মের ফলগুলো জীবাণুমুক্ত করে প্যকেট করা যেতে পারে। সর্বোপরি দরকার ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার বিজ্ঞানসম্মত উপায় আবিষ্কার করা ।

খাবারে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে, তা বিদেশ থেকে আমদানি করা। প্রয়োজনীয় কাজে আমদানি করতে দ্বিমত নেই। চাইছি যত্রতত্র ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ। সাংবাদিক নঈম নিজাম বলেন, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ খাদ্যকে বিশুদ্ধ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা খাদ্যকে বিষে পরিণত করার জন্য রীতিমতো উঠে পড়ে লেগেছি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে যেখানে ১৯৮০ এর দশকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখ সেখানে বর্তমানে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০-৯০ লাখ, বর্তমানে প্রায় ২০-২২ শতাংশ লোক হৃদরোগে আক্রান্ত এবং ১০-১২ লাখ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত (বাংলাদেশ প্রতিদিন এপ্রিল-২০১৫)।

সুতরাং পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাই কঠোর আইনের প্রয়োগ। এসব রাসয়নিক দ্রব্য আমদানি, সংরক্ষণ, মজুদকরণ, বিতরণ, ব্যবহার ও উম্মুক্ত বিক্রির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে এবং জনগণকে ভেজাল খাদ্য ক্রয় ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার

উপপরিচালক (কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি) জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি, গাজীপুর [email protected]

স্বাস্থ্য বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর