ঢাকা, ২০ এপ্রিল শনিবার, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৫৫৭

জটিল রোগের ঝুঁকিতে মানুষ

কৃত্রিমতা ছেড়ে অর্গানিক খাবারেই ফিরতে হবে

অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:৫৪ ৩০ জুন ২০১৯  

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির উদ্যোগে দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় চালে মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এতে চালের ২৩২ নমুনার মধ্যে ১৩১টিতে বিভিন্ন মাত্রায় মানুষের জন্য বিপজ্জনক ক্রোমিয়াম, ১৩০টিতে ক্যাডমিয়াম, সমসংখ্যক নমুনায় সিসা, ৮৩টিতে আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে।

এ ছাড়া ২০টি নমুনার মধ্যে তিনটিতে পাওয়া যায় আফলাটক্সিন। এ ক্ষেত্রে আফলাটক্সিনের মাত্রা (০.০০০৪-০.০০১৩) সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (০.০১) নিচে থাকলেও ৫৬টি নমুনায় ক্রোমিয়াম, ১৭টিতে ক্যাডমিয়াম, ২২টিতে সিসা এবং পাঁচটিতে আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে মানুষের শরীরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

 

ইউরোপীয় কমিশনের নীতিমালা অনুসারে মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১ পিপিএম। কিন্তু ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি বা জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় চালে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৩.৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ০.১ হলেও পাওয়া গেছে ৩.২৩৯৫ পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা ০.২ হলেও পাওয়া গেছে ১.৮৭ পর্যন্ত।

জানা গেছে, ওই গবেষণায় চাল বা ধান ছাড়াও আলু, বেগুন, টমেটো, মাছ, মুরগির মাংস, কলের পানি, তরল দুধ ও গরুর খাবার নিয়েও কাজ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে শুধু গরুর দুধ ও খাবারের বিষয়ে গবেষণার ফলে চূড়ান্ত হওয়ায় গত মাসে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।

 

গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, তরল দুধ, গোখাদ্য ও দইয়ে ক্রোমিয়াম-ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতু রয়েছে। পাওয়া গেছে কীটনাশকের অস্তিত্বও। ছিল ক্ষতিকর মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক। বিশেষ করে গরুর খাবারের ৩০টি নমুনার মধ্যে ৬৯ থেকে ১০০ শতাংশ কোনো না কোনো রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে। কোনো কোনোটিতে একই সঙ্গে কয়েক ধরনের রাসায়নিক পাওয়া যায়। ১৬টিতে ছিল ক্রোমিয়াম। অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় সব নমুনাতেই।

 

ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে ঢুকলে তা বের হতে পারে না। সব কটিই দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া ক্যান্সারসহ নানা ধরনের ক্রোনিক রোগের বড় উৎস হচ্ছে এসব রাসায়নিক। এককথায় এগুলোর সব কটিই ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম।

 

ফসল ও মাছে ভারী ধাতু ঢুকছে মূলত মাটি ও পানি থেকে। মাটি ও পানি এমনভাবেই রাসায়নিক দূষণের কবলে পড়েছে, যা খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে ঢুকে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। নানা ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে মানুষকে। দিনে দিনে এ সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সর্বাত্মক সচেতনতা ও সতর্কতা। কলকারখানার বর্জ্য থেকে ভয়ানক বিপদে পড়ছে আমাদের খাদ্যচক্র। সেই সঙ্গে চাষাবাদের সময় জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারও বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিকের প্রভাবও রয়েছে দেশের বেশির ভাগ এলাকায়। অনেক রাসায়নিক ও কীটনাশকযুক্ত ঘাস-পানি বা লতাপাতা গবাদি পশু খেলে তা দুধ, ডিম কিংবা মাংসের মাধ্যমে মানুষের দেহে তো ঢুকবেই। এর মধ্যে ভারী ধাতুগুলো আগুনের তাপেও নষ্ট হয় না, মানুষের শরীরে জমে জমে ক্ষতি করতে থাকে।

 

রাসায়নিক দূষণযুক্ত পানি-মাটি আর ফসলে ব্যবহৃত সার-কীটনাশক থেকেই ধানে ভারী ধাতু মিশ্রণের আশঙ্কা থাকে। শিল্প-কারখানার বর্জ্যদূষণ এখন মাটির জন্য বড় বিপদ ডেকে এনেছে।

 

কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় শাকসবজি, চিংড়ি ও শুঁটকিতে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের অস্তিত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। দেশের ১২ জেলা থেকে সংগৃহীত ৪৫৪টি নমুনা পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে বারি ওই তথ্য জানিয়েছিল। ২০১৫ সালের মার্চে অষ্টম ওয়ান হেলথ বাংলাদেশ সম্মেলনে উপস্থিত এসংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। ওই সম্মেলনে উপস্থিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে মানুষের প্রধান খাদ্য ভাতে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

 

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেসব খাবার খাই, তার গুণগত মানের নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকারের সেদিকে তেমন নজর আছে বলে মনে হয় না। নজর থাকলেও সারা দেশে দুর্নীতির মাত্রা এত ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে যে সরকারের পক্ষে তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাবারের নিরাপত্তা বিধানে বেশ তৎপর রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে খাবারের যথাযথ মান বিচার করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। ময়লা, আবর্জনা, নোংরা, দুর্গন্ধময় ও অস্বাস্থ্যকর নকল, ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার—যা-ই হোক, তা-ই মানুষ খেতে বাধ্য হচ্ছে।

 

বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ও অযৌক্তিক ব্যবহারে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা পয়সার জন্য নিয়ম-নীতির যেমন তোয়াক্কা করে না, তেমনি ওষুধ ব্যবসায়ীরাও মুনাফার জন্য বিধি-নিষেধ অমান্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।

 

বিধি মোতাবেক সব অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড হরমোন প্রেসক্রিপশন ড্রাগ। এসব স্টেরয়েড প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা যায় না, যেমন কেনা যাওয়ার কথা নয় অ্যান্টিবায়োটিকও। অথচ মোটা-তাজা ও ওজন বাড়ানোর জন্য গবাদি পশুর ওপর স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ এ দেশে এখন সাধারণ ঘটনা। কেউ যদি হরমোনসমৃদ্ধ গরু, শূকর ও মুরগির মাংস খায় এবং দুধ পান করে, তবে এসব ক্ষতিকর হরমোন পরোক্ষভাবে মানুষের শরীরে ঢুকে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। হরমোনসমৃদ্ধ মাংস ও দুধ খেলে মানুষের শরীরে বাড়তি হরমোন প্রবেশের কারণে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হরমোনমাত্রায় ভীষণ তারতম্যের সৃষ্টি হয়। কারণ শরীর এমনিতেই এসব হরমোন পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রস্তুত করে থাকে। এসব বাড়তি হরমোন গ্রহণের কারণে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বাড়ন্ত শরীরে খাদ্য থেকে প্রাপ্ত সামান্য পরিমাণ হরমোনও শরীরে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে।

শিশুদের শরীরে অত্যন্ত অল্প পরিমাণে প্রাকৃতিক হরমোন থাকে। মাংসে সামান্য পরিমাণ হরমোনের উপস্থিতি শিশুদের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্টেরয়েডের সবচেয়ে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ, এলডিএলের মাত্রা বৃদ্ধি, এইচডিএলের মাত্রা হ্রাস, ইশকিমিয়া, মাইওকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোক, অস্টিওপোরোসিস, প্রোস্টেটগ্ল্যান্ড ও স্তনের আকার বৃদ্ধি, প্রজননক্ষমতা হ্রাস। এসব স্টেরয়েড হরমোন শরীরের প্রাকৃতিক হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, শরীরের প্রতিরোধক্ষমতায় অস্থিতিশীলতা ডেকে আনে, ক্যান্সার সৃষ্টি ছাড়াও লিভার ও কিডনি ধ্বংস করতে পারে।

বিপদ আরো আছে। গবাদি পশুর মলমূত্রের মাধ্যমে এসব হরমোন আবার পরিবেশে ফিরে আসে। যা আবার অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মানবদেহে ঢুকে আবার সমস্যা সৃষ্টি করছে।

 

বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক স্বাস্থ্যবান গবাদি পশুর ওপর প্রয়োগ করা হয় তাদের বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য। এসব গবাদি পশু ও পোল্ট্রির ক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটিক এমন সব সুপারবাগ (এমন জীবাণু, যার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়) নামের দানব সৃষ্টি করছে, যা মানবসভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবাদি পশু ও পোল্ট্রিতে ব্যাপক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে পড়েছে। পশুপাখির ওপর প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে এমন সব সুপারবাগের উৎপত্তি হচ্ছে, যা প্রথমত, মাংসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে এবং দ্বিতীয়ত, পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার ঘটাচ্ছে। এসব সুপারবাগ জিন ট্রান্সফার বা মিউটেশনের মাধ্যমে অন্যান্য জীবাণুকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করছে।

 

গবাদি পশু ও পোল্ট্রিতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে সৃষ্ট রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু জনস্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি করে। এসব ক্ষতির মধ্যে রয়েছে—সংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যর্থ হয়ে যাওয়া এবং সংক্রামক রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়া। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে জীবাণুর বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যার ফলে রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল জীবাণুর চেয়ে অনেক দ্রুত ঘটে থাকে। ফলে এসব রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর কারণে মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা ও ঝুঁকি সংবেদনশীল জীবাণুর চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।

 

মাংস উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে যে সুপারবাগের সৃষ্টি হচ্ছে, তা একসময় মহামারি আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মানবসভ্যতার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এই কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফডিএ ও বিশ্বের ভোক্তাসংগঠনগুলো ত্রিশ বছর ধরে গবাদি পশু ও পোল্ট্রিতে স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিক একান্ত প্রয়োজন না হলে ব্যবহার না করার জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তাসংগঠনগুলো মনে করে, মাংস উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করে জনস্বাস্থ্য তথা মানবসভ্যতাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশেও স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে গবাদি পশু ও পোল্ট্রি উৎপাদিত হচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সরকার ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে অনতিবিলম্বে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে—এটা দেশবাসীর প্রত্যাশা।

 

দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শাকসবজি ও ফলমূলও কমবেশি খেতে হয়। শাকসবজি ও ফলমূলও নির্ভেজাল নয়। কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে শাকসবজি ও ফলমূল রক্ষা করার জন্য একদিকে ব্যবহার করা হয় কীটনাশক এবং ফলমূল পাকানো ও পচন রোধের জন্য অন্যদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ফরমালিন। যে শাকসবজি বা ফলমূল মানুষ খায়, তাতে ব্যবহৃত ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন ও কীটনাশক যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানবদেহের অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনে, তবে সেসব কীটনাশক, ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ফরমালিন যেকোনো মাত্রায় ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন তুলে কী হবে, যদি এসব ক্ষতিকর রাসায়নিকের অপব্যবহার রোধ করা না যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিশ্বায়নপ্রক্রিয়া আমাদের ক্রমাগত অতিপ্রাকৃতিক করে তুলছে। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। এসব মৃত্যুর বেশির ভাগ ঘটে অনুন্নত বিশ্বে।

কীটনাশক ব্যবহারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কৃষকের প্রশিক্ষণ থাকে না এবং এই কারণে কীটনাশকের অপব্যবহার হয়। কীটনাশকের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু ও উঠতি বয়সের শিশুরা। এমনকি খুব অল্প পরিমাণ কীটনাশক পর্যন্ত বাড়ন্ত ছেলে-মেয়েদের বয়োবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কীটনাশক শরীরে প্রবেশ করলে যেসব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে স্মৃতিশক্তি বিলোপ, সমন্বয়হীনতা, উদ্দীপকের প্রতি বিলম্বে সাড়া প্রদান, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও আচরণ, স্নায়ুর দক্ষতা হ্রাস, হাঁপানি, অ্যালার্জি, অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা, ক্যান্সার, হরমোনের কার্যাবলি বাধাপ্রাপ্ত হওয়া, প্রজনন ও ভ্রূণের বয়োবৃদ্ধির সমস্যা।

 

ফরমালিন, ফসফরাস ও আর্সেনিকসমৃদ্ধ ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও কীটনাশকের প্রতি শিশুরা হয় অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। ফলমূল ও শাকসবজিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও সব রকম বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় ক্যান্সারে। আপেল, টমেটো, জাম, মরিচ, আঙুর, লেটুস, ব্রকোলি, স্ট্রবেরি, পালংশাক, সবুজ শিম, মটরশুঁটি, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পটোল, শসা, ঢেঁড়স, করলা ইত্যাদিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। অনেক শাকসবজি ও ফলমূল ঘষে লবণ-পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিলে ফরমালিন বা কীটনাশকের মাত্রা কমে যায়।

কীটনাশকের ধরন, পরিমাণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশের জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তাই সরকারের উচিত কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া ও স্বাস্থ্যসচেতনতা তৈরি করা। পশ্চিমা বিশ্বে অর্গানিক খাবারের কদর দিন দিন বাড়ছে। আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতিতেই রয়েছে প্রকৃত সমাধান। তাই আমাদের কৃত্রিমতা ছেড়ে প্রকৃতিতেই ফিরে যেতে হবে। তা না হলে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শাকসবজি, ফলমূল রপ্তানিতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।