ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১৮৩৯

তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব

মোঃ ফজলুল হক

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৫:৫২ ২৩ জানুয়ারি ২০২০  

১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু উড়িষ্যার কটকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু চব্বিশপরগনা জেলার কোদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসুর আবির্ভাব এক বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে। সূর্যসেনের ফাঁসির সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের দিনও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। মহাত্না গান্ধীর বৃটিশ তোষণের রাজনীতিতে অনেকে তখন বীতশ্রদ্ধ। অন্যদিকে গোঁড়া ধর্মবাদী রাজনীতিকদের ঘিরে দানা বাঁধতে থাকে সাম্প্রদায়িকতা। সাধারণ মানুষের অনেকে তখন তাকিয়ে রয়েছেন নেতাজী সূভাষচন্দ্র বসুর দিকে। অনেকের কাছে তখন তিনিই একমাত্র স্বাধীনতার প্রতীক। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষ বসু দৃপ্তকন্ঠে বলেন,‘‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’’ ভগৎ সিং এর মৃত্যুর পর সুভাষবসু বলে উঠেছিলেন,’’ পদানত এই ভারতবর্ষ আজ হাজার হাজার ভগৎ সিং চাইছে।’’


সুভাষ বসু ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় মেধাস্থানসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে একই কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমুলক মন্তব্য করায় কলেজের প্রফেসর ইএফ ওটেনকে কয়েকজন ছাত্র মিলে মারধর করে, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন সুভাষ বসু। একারণে প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলেজ থেকে বহিস্কার করে।


১৯১৮ সালে সুভাষ বসু স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সম্মানসহ দর্শনশাস্ত্রে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর বাবার ইচ্ছায় সুভাষ বসু আইসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান লাভ করেন। কিন্তু সিভিল সার্ভিসে যোগদান না করে ভারতে ফিরে এসে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন।


১৯২৪ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কোলকাতা করপোরেশনের মেয়র হলে সুভাস বসুকে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্ম কর্তা পদে নিয়োগ করা হয়। জঙ্গি জাতীয়তাবাদীদের সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ঐ বছরই তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯২৭ সালে মুক্তিলাভের পর সুভাষ বসুকে বাংলা কংগ্রেসের সভাপতি করা হয়। ১৯২৮ সালে কোলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক সম্মেলনে সুভাষ বসু ও জওহরলাল নেহরু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন। কিন্তু গান্ধী ও মতিলাল নেহরু ভারতের ডোমিনিয়ন মর্যাদার অনুকুলে মত দেন। ১৯৩০ সালে সুভাষ বসু কোলকাতা করপোরেশনের মেয়র হন।


মহাত্না গান্ধীর লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করায় ১৯৩০ সালে সূভাষ বসুকে কারারুদ্ধ করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৩১ সালের গান্ধী-আরউইন চুক্তির বিরোধিতা করেন সুভাষ। এজন্য তাঁকে আবারো গ্রেফতার করে। কারাগারে তাঁর স্বাস্থের অবনতি হলে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তিলাভ করে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যান।


১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে পরপর দু‘বার সুভাষ বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধীর বিরোধীতার কারণে ১৯৩৯ সালেই সুভাষ কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন এবং কংগ্রেসের ভেতরেই তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪০ সালের জুন মাসে ফরওয়ার্ড ব্লকের নাগপুর অধিবেশনে সূভাষ ভারতে অস্থায়ী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করেন।


নবাব সিরাজউদ্দৌলার কলঙ্ক মোচনের উদ্দেশ্যে কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার জন্য হিন্দু-মুসলমান সবাইকে আহবান জানান সুভাষ। কিন্তু হলওয়েল মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার নির্ধারিত দিনের আগেই সুভাষকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে জেলের ভেতরে তিনি আমৃত্যু অনশন আরম্ভ করেন। জেলখানায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সুভাষকে মুক্তি দিয়ে কোলকাতায় তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখা হয়।


১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি রাতে বৃটিশ সরকারের গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে সুভাষ বসু কোলকাতা ত্যাগ করেন। মৌলভীর ছদ্মবেশে তিনি ধানবাদ-গোমো হয়ে রেলপথে পেশোয়ার চলে যান। সেখানে পাঠানের ছদ্মবেশে জিয়াউদ্দিন নাম ধারণ করে কাবুলে গিয়ে পৌঁছেন। কাবুলে ৪৩ দিন অবস্থান করে ইতালীয় রাষ্ট্রদুতের ব্যবস্থাপনায় সুভাষ মস্কো গিয়ে হাজির হন। মস্কোয় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদুতের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে তিনি বার্লিন চলে যান।


বৃটিশ সরকার ভারতে সুভাষকে দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারা রয়টারের মাধ্যমে সুভাষের মৃত্যুর খবরও প্রচার করে। এমন সময় ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর ইথারে ভেসে এল সুভাষ বসুর কন্ঠস্বর- -‘‘আজাদ হিন্দ রেডিও বার্লিন, আমি সুভাষ বলছি-- -- -’’।


জার্মানীর হিটলারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় সুভাষ সাবমেরিনে করে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে জাপান চলে যান। ইতোমধ্যে জাপানীদের হাতে বন্দী বৃটিশ ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে বিপ্লবী রাসবিহারী বসূ এক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। সুভাষকে পেয়ে রাসবিহারী বসু ঐ বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেন সুভাষের হাতে।


ভারতের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য গঠিত ঐ বাহিনীর নাম দিলেন সুভাষ আজাদ হিন্দ ফৌজ। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল জাপান, বার্মা, ক্রোয়েশিয়া, জার্মানী, চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার, ইতালী ও থাইল্যান্ড। ৫০০০০ সৈন্য নিয়ে সুভাষ বসু রেঙ্গুন থেকে ভারতের পথে অভিযান পরিচালনা করেন। বৃটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে আজাদ হিন্দ ফৌজ কোহিমা দখল করে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ দুটিরও নিয়ন্ত্রন পায় আজাদ হিন্দ ফৌজ।


কিন্তু বর্ষাকাল আরম্ভ হলে রসদপত্রের স্বল্পতার কারণে আজাদ হিন্দ ফৌজ পরাজিত হতে থাকে। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর তীব্র আক্রমণের সামনে ১৯৪৫ সালের ১৩ মে পেগুতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বশেষ সেনাদলটি আত্নসমর্পণ করে।


নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর শেষ পরিণতি আজো রহস্যাবৃত। প্রচলিত ধারণা ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের তাইহকু বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসু নিহত হয়েছেন।


ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশদের বিদায় করার পেছনে সুভাষচন্দ্র বসুর ভুমিকাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। ইংরেজ ঐতিহাসিক মাইকেল স্টুয়ার্ট তার ‘লাস্ট ইয়ারস অব বৃটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ‘‘It slowly dawned upon the government of India that the backbone of the British rule, the Indian Army, might now no longer be trustworthy. The ghost of Subhas Bose , like Hamlet`s father, walked the battlements of the Red Fort (where INA soldiers were being tried) , and his suddenly amplified figure overawed the conference that was to lead to Independence.''
 

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর