ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৩২০

মানব কম্পিউটার ‘শকুন্তলা দেবী’

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৬:৫০ ১৫ জানুয়ারি ২০২১  

আচ্ছা, বলুন তো ১৩ অঙ্কের দু'টি সংখ্যা গুণ করতে সর্বোচ্চ কতক্ষণ লাগতে পারে? যেমন ধরুন, ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০ এবং ২,৪৬৫,০৯৯,৭৪৫,৭৭৯ সংখ্যা দু'টি গুণ করে সঠিক উত্তর দিতে আপনার কত সময় লাগবে? কয়েক সেকেন্ডে পারবেন? অসম্ভব কোনোকিছু মনে হচ্ছে কি? মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

 

কিন্তু একজন ব্যক্তির জন্য এই অসম্ভব কাজ করতে তথা সঠিক উত্তর (১৮,৯৪৭,৬৬৮,১৭৭,৯৯৫,৪২৬,৭৭৩,৭৩০) দিতে সময় লেগেছিল মাত্র ২৮ সেকেন্ড! যে ব্যাক্তি বলেছেন তিনি একজন ভারতীয় লেখক এবং মানব ক্যালকুলেটর ‘শকুন্তলা দেবী’। তাকে ‘মানব কম্পিউটার’ নামে ডাকা হয়। 

 

গণনা করার অসাধারণ ক্ষমতার কারণেই বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন ‘মানব কম্পিউটার’ হিসেবে। বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য তাকে ১৯৮২ সালে ‘গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গণনা করার বিশেষ ক্ষমতার পাশাপাশি গাণিতিক বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েও যথেষ্ট ধারণা ছিল শকুন্তলার।

 

তিনি ব্যাঙ্গালুরুতে একটি কন্নড় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম তারিখ ১৯২৯ সালের ৪ নভেম্বর। বাল্যকালে শকুন্তলার অসাধারণ স্মরণ শক্তি ও সংখ্যা গণনার দক্ষতাকে তার বাবা বেশি গুরুত্ব দেননি। যদিও মাত্র তিন বছর বয়সে তাকে তাসের বিভিন্ন খেলা রপ্ত করিয়ে ফেলেছিলেন।

 

শকুন্তলার বাবা ছিলেন একটি সার্কাসের দলে। তিনি ওই দল ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন ‘রোড শো’ শুরু করেন। তিনি প্রথাগত কোনও শিক্ষায় শিক্ষিত হননি। মাত্র ছয় বছর বয়সে শকুন্তলা মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে অসাধারণ এই দক্ষতার প্রদর্শনী করেন। ১৯৪৪ সালে শকুন্তলা তার পিতার সাথে লন্ডন চলে আসেন। এরপর ১৯৬০ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি ভারতে চলে আসেন।

 

শকুন্তলা দেবীর এই অসাধারণ ক্ষমতা প্রকাশ পেলে বিশ্বব্যাপী তার প্রদর্শনী শুরু হয়।  তিনি খুব সহজেই তিনের বর্গমূল, উচ্চতর বর্গমূল বের করতে পারতেন এবং বড় বড় সংখ্যা গুণ করতে পারতেন। ১৯৫০ সালের দিকে ইউরোপে এবং ১৯৭৬ সালে নিউইয়র্কেও তিনি তার দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৭৭ সালে সাউদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১ অঙ্কের একটি সংখ্যার ২৩তম বর্গমূল মাত্র ৫০ সেকেন্ডে বের করে সকলকে বিস্মিত করে দেন।

 

তার উত্তর ছিল ৫৪৬,৩৭২,৮৯১; যা নিশ্চিত করা হয় তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কম্পিউটার ইউনিভ্যাক-১১০১ এর মাধ্যমে। মাত্র ৫০ সেকেন্ডে শকুন্তলা এ উত্তর দিতে পারলেও বিশেষজ্ঞদের ইউনিভ্যাকে একটি বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করতে হয় এর সঠিক উত্তর বের করার জন্য। আর ইউনিভ্যাকের এ অঙ্ক কষতে সময় লাগে ৬২ সেকেন্ড।

 

১৯৮৮ সালে শকুন্তলা যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর্থার জেসন এ অসাধারণ প্রতিভার রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করেন। এ তাগিদে জেসন তার কিছু পরীক্ষাও নেন। এসব পরীক্ষার মধ্যে দু'টি হলো- ৬১,৬২৯,৮৭৫ এর তিনের বর্গমূল এবং ১৭০,৮৫৯,৩৭৫ এর সাতের বর্গমূল বের করা।

 

জেসনের মতে, এই গাণিতিক সমস্যাগুলো তিনি তার নোটবুকে তুলে শেষ করার আগেই শকু্ন্তলা এগুলোর সঠিক উত্তর (৩৯৫ এবং ১৫) বলে দেন। জেসন তার প্রাপ্ত তথ্যগুলো দিয়ে ১৯৯০ সালে বই ‘ইনটেলিজেন্স’ প্রকাশ করেন। শকুন্তলার আরেকটি বিশেষ দক্ষতা ছিল দিন-তারিখের হিসাব নিয়ে। ১৯৮৮ সালে বার্কলিতে 'জুলাই ৩১, ১৯২০' তারিখে কোন বার ছিল জানতে চাওয়া হলে মাত্র এক সেকেন্ডেই তিনি উত্তর দিয়ে দেন।

 

১৯৮০ সালের ১৮ জুন যুক্তরাজ্যের ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনে শকুন্তলাকে ১৩ অঙ্কের দু'টি সংখ্যা গুণ করতে দেওয়া হয়। সংখ্যাগুলো পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। বাছ-বিচার ছাড়াই তৎক্ষণাৎ লেখা হয়। এটার কথাই লেখার শুরুতে বলেছিলাম। এই গুণ করতে তার সময় লাগে মাত্র ২৮ সেকেন্ড।

 

পরদিনই ‘দ্য বুলেটিন' পত্রিকায় এই রেকর্ডের কথা প্রকাশ করা হয়। তার এ রেকর্ডের দরুন ১৯৮২ সালে ‘গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ তাকে স্বীকৃতি দেয়। আর সেইসাথে ‘বিশ্বের দ্রুততম মানব কম্পিউটার’ হওয়ার খেতাব পান তিনি।

 

শকুন্তলা দেবী তার জীবদ্দশায় বেশ কিছু বই লিখে গেছেন। এর মধ্যে অন্তত ছ'টি বই এরকম ছিল, যা পরবর্তী প্রজন্মকে গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তার বইগুলো দেখলে বোঝা যায়, বিভিন্ন গাণিতিক বিষয় যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত, যেমন- ত্রিকোণমিতি ও লগারিদম সম্পর্কেও জানতেন।

 

তার সেরকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও এসব বিষয়ে এত দক্ষতা কীভাবে এল, তা নিয়ে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন বই পড়ার মাধ্যমে এসব বিষয়েও পারদর্শী হন। উল্লেখ্য, তিনি জীবদ্দশায় একটি ক্রাইম থ্রিলারও লিখেছেন, যার নাম 'পারফেক্ট মার্ডার'।

 

১৯৬০ সালের মাঝামাঝি পরিতোষ ব্যানার্জির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শকুন্তলা দেবী। তাদের ঘরে একটি মেয়ে হয় যার নাম অনুপমা ব্যানার্জী। ডিভোর্সের পর শকুন্তলাই তাকে পেলে-পুষে বড় করেন। বিয়ের কয়েক বছর পরই তাদের বিয়েটি ভেঙে যায়। বলা হয়ে থাকে পরিতোষ সমকামী ছিলেন যার কারণে তাদের বিয়েটি ভেঙে যায়।

 

আর সেজন্যই শকুন্তলা দেবীও সমকামিতা নিয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ হন। ২০০১ সালের একটি তথ্যচিত্র “ফর স্ট্রেইটস অনলি”-তে এই দাবি করা হয়। সেই সময়ে সমকামিতা শুধু সমাজের চোখে নয়, বরং আইনের চোখেও ছিল নিকৃষ্ট অপরাধ। সেই সত্তরের দশকে শকুন্তলা সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটান যেন তাদের মন-মানসিকতা ও জীবনযাপনের ধরন বুঝতে পারেন।

 

তার এই দীর্ঘ সময়ের গবেষণার ফল ছিল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব হোমোসেক্সুয়ালিটি’ বইটি। এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে, তবে সেই সময়ে বইটি সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানসিকতার কারণে সেরকম স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পায় তার বইটি। ভারতে সম্ভবত সমকামিতা সম্পর্কে এত বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে সেরকম বই এটিই প্রথম। উল্লেখ্য যে, শকুন্তলার মেয়ে অনুপমা ব্যানার্জী দাবি করেন তার পিতা পরিতোষ সমকামী ছিলেন না।

 

২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল শকুন্তলা দেবী নিজ জন্মস্থান তথা বেঙ্গালুরুতে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা যান। এই সময় তার বয়স ছিল ৮৩ বছর। তাছাড়া মৃত্যুর বেশ আগে থেকে হার্ট ও কিডনির বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বরে তার ৮৪ তম জন্ম দিবসে গুগল তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিশেষ ডুডল তৈরি করে।

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর