ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১১১৮

শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতনের নেপথ্যে

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:১০ ২২ জুলাই ২০১৯  

দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না। টানা দরপতনের কারেন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাড়িয়েছে, যারা এখনও অপেক্ষায় আছেন তারাও বাজার থেকে শেয়ার বিক্রি করে যাবার পথ খুজছেন। 
 শেয়ারবাজারের পতনরোধে গত কয়েক মাসে নানা কার্যকরি সংস্কার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বহুদিনের চাহিদা বিনিয়োগসীমা সংশোধন, প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইন এর মেয়াদ বৃদ্ধি, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) সাধারন বিনিয়োগকারীদের কোটা বৃদ্ধি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া বিতর্কিত বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সংশোধন করা হয়েছে। তারপরেও শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক পতন হচ্ছে। যদিও আইপিও’র মাধ্যমে শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানির মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে। এছাড়া একটি কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মধ্যে সৃষ্ট দুরত্ব বাজারে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে।

দেখা গেছে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫৯৫০ পয়েন্ট। যা ২১ জুলাই কমে দাড়িঁয়েছে ৫০৩৪ পয়েন্টে। অর্থাৎ ৬ মাসে সূচক কমেছে ৯১৬ পয়েন্ট বা ১৫.৩৯ শতাংশ। এই পতনের ফলে সূচকটি বিগত আড়াই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। আর এই পতনের কারন অনুসন্ধানে রবিবার (২১ জুলাই) ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি।

সম্প্রতি একটি কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়ে বিএসইসি ও ডিএসই কর্তৃপক্ষ দুই মেরুতে অবস্থান করছে। যা আরও ফুটে উঠেছে কমিশন ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পূণঃনিয়োগ ঝুলিয়ে রাখার মাধ্যমে। গত মে মাসে কেএএম মাজেদুর রহমানকে ডিএসইর এমডি হিসাবে পূণঃনিয়োগের বিষয়ে অনুমতি চেয়ে বিএসইসিকে চিঠি দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোন উত্তর দেয়নি বিএসইসি। এরইমধ্যে গত ১১ জুলাই ডিএসই থেকে বিদায় নিয়েছেন মাজেদুর রহমান। তবে কমিশনের কোন জবাব না পাওয়ায় মাজেদুর রহমানকে পূণ:নিয়োগ বা নতুন এমডির খোজেঁ বিজ্ঞপ্তি দিতে পারছে না ডিএসই কর্তৃপক্ষ।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, শেয়ারবাজারে পতনের একটি কারন হচ্ছে সার্বিকভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। তবে কেনো নষ্ট হয়েছে সেটা পরিস্কার না। আরেকটি কারন হচ্ছে ব্যাংক খাতের ঋণ সরবরাহ কমে গেছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী ঋণ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ঋণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফা কমবে। এছাড়া একটি লিজিং কোম্পানি অবসায়ন হচ্ছে। অন্যদের অবস্থাও খুব একটা সন্তোষজনক না। এসব বিষয়গুলো বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, দাম নিয়ন্ত্রন করা কমিশনের কাজ না। তাদের দেখার বিষয় হচ্ছে কোন যোগসাজোশ হচ্ছে কিনা। এর বাহিরে দাম উঠলো কি কমলো, সেটা দেখা বিএসইসির কাজ না। সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মানসিকতা। কয়েকজন বিক্রি শুরু করলেই অন্যরা বিক্রি শুরু করে। বিনিয়োগকারীদের এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে, চলমান পরিস্থিতি ঠেকানো বেশ মুশকিল। তাদেরকে বিচার বিশ্লেষন করে বিনিয়োগ করা উচিত। এখন শেয়ারবাজার অবমূল্যায়িত। ফলে এখন বিনিয়োগের অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগকারীরা সেদিকে কেনো এগোচ্ছে না, সেটা আমার কাছে পরিস্কার না। আর কোন একটি কোম্পানির ইস্যুতে সার্বিক বাজারে অনাস্থার সৃষ্টি হওয়া উচিত না বলে যোগ করেন তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, গত কয়েকবছরে যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসেছে, তার অধিকাংশ কোম্পানির নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে নানা অসংগতি রয়েছে। এসব নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের মান সর্ম্পক্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া কোন কোম্পানির আর্থিক হিসাব গড়মিলের প্রমাণ পাওয়া গেলেও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। শেয়ারবাজারে আসতে আগ্রহী কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষকের মান স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের মনে নিরীক্ষকদের প্রতিবেদন সর্ম্পক্যে অনাস্থা তৈরী হয়েছে। বর্তমানে নিরীক্ষকের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করা রীতিমতো ভয়ের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে যত সংস্কারই করা হচ্ছে না কেনো, তাতে শেয়ারবাজারে এই মুহূর্তে কার্যকরি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। তবে স্টেকহোল্ডারদের দাবির প্রেক্ষিতে যেসব সংস্কার করা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে তার সুফল পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংক ও লিজিং খাতের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। আর এই খাত দুইটি ভয়াবহ সময় পার করছে। যাতে ব্যাংক ও লিজিং খাতের শেয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যা শেয়ারবাজারে পতনে বড় ভূমিকা রাখছে। আর এই পতনে সবাই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। গ্রামীনফোনের মতো বড় মূলধনী কোম্পানির ট্যাক্স সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন না হওয়াও শেয়ারবাজার পতনের আরেকটি কারন।

গত ১৬ মে দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশিত বিনিয়োমসীমা সমাধানে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এলক্ষ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে অতালিকাভুক্ত ( ইক্যুইটি শেয়ার, নন-কনভার্টঅ্যাবল প্রিফারেন্স শেয়ার, নন-কনভার্টঅ্যাবল বন্ড, ডিবেঞ্চার, ওপেন-ইন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড) সিকিউরিটিজকে বাদ দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাতে শেয়ারবাজারে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো যাবে।

আরআইইউ প্রদানের সুযোগের মাধ্যমে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে। তবে গত ১৬ জুলাই বিএসইসি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আরআইইউ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে আগামিতে বে-মেয়াদী এবং মেয়াদী উভয় ধরণের ফান্ডের ক্ষেত্রেই কেবল মাত্র নগদ লভ্যাংশ প্রদান করা যাবে।

চলমান পতনের শুরুতে আলোচনায় উঠে আসে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য। এর মাধ্যমে টাকা বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জুলাই প্লেসমেন্ট শেয়ার বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) পূর্ব ইস্যুকৃত শেয়ারে লক-ইন ২ বছর করে পাবলিক ইস্যু রুলসের সংশোধনীর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। যা প্রসপেক্টাসের সংক্ষিপ্ত সংস্করন প্রকাশের দিনের পরিবর্তে লেনদেন শুরুর দিন থেকে গণনা করা হবে। তবে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর পরে আইপিও অনুমোদনে ৪ বছরের বেশি সময় লাগা কোম্পানির ক্ষেত্রে ১ বছর লক-ইন করা হয়েছে।

আইপিওতে কোটা বাড়ানো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে সাধারন বিনিয়োগকারীরা। এ লক্ষ্যে কমিশন বুক বিল্ডিংয়ে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কোটা ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সাধারন বিনিয়োগকারীদের কোটা ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হবে। অন্যদিকে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কোটা ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ এবং সাধারন বিনিয়োগকারীদের কোটা ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও কোন কাজ হচ্ছে না। বাস্তবে বিনিয়োগ কারীদের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারনে পুজিবাজারে অস্বাভাবিক দরতপন ঘটছে। 

ফিচার বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর