ঢাকা, ০১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার, ২০২৬ || ১৭ পৌষ ১৪৩২
good-food
১৮

স্বামীর পাশে চিরনিদ্রায় খালেদা জিয়া

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:২৮ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫  

জেল-জুলুম, নির্যাতন, বন্দিত্ব, অসংখ্য অপমান আর শারীরিক যন্ত্রণার মাঝেও অবিচল থাকা আপসহীন নেত্রী, আধিপত্যবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অবশেষে জীবনের পরম সত্যের কাছে নিজেকে সঁপে দিলেন। অনন্ত যাত্রায় কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমালেন পরপারে। শায়িত হলেন প্রিয় স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে, শেষ গন্তব্যে চিরনিদ্রায়।

আজ বুধবার বিকাল পৌনে ৫টায় সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার শেষে জিয়া উদ্যানে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খালেদা জিয়াকে দাফন করা হয়। ধর্মীয় রীতি মেনে তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান নিজে সবার আগে কবরে নেমে নিজ হাতে মাকে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করেন। মায়ের কবরে সবার আগে মাটিও দেন তিনি। এরপর পরিবারের নারী সদস্যসহ অন্যান্যরা কবরে মাটি দেন। এরপর একে একে অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, তিন বাহিনীর প্রধান, বিএনপির শীর্ষ নেতারা কবরে মাটি দেন।

দাফনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে তাঁদের সামরিক সচিব খালেদা জিয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া তিন বাহিনীর প্রধান খালেদা জিয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে খালেদা জিয়ার রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। দাফন করার আগে সকাল থেকেই জিয়া উদ্যান সংলগ্ন লেক রোডে সাধারণ মানুষের যাতায়াত বন্ধ ছিল। দুপুরে জোহরের নামাজের পর মনিক মিয়া এভিনিউতে খালেদা জিয়ার জানাজা হয়।

এসময় সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। এসময় তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, ছোট ভাই আরাফাত রহমানের স্ত্রী শামিলা রহমান, তার ছোট মেয়ে জাফিরা রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা, বিএনপির নেতাকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা দাঁড়িয়ে শোক ও শ্রদ্ধা জানান। দাফনকালে পরিবারের সদস্য, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিদেশি অতিথি ও বিএনপির মনোনীত প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বিশেষ একটি বাহনে করে খালেদা জিয়ার মরদেহ সাবেক রাষ্ট্রপতি ও তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের সমাধির কাছে নেওয়া হয়। সমাধির কাছাকাছি নেওয়ার পর খালেদা জিয়ার মরদেহবাহী কফিন দাফনের স্থানে কাঁধে নিয়ে যান সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা।

এর আগে বিকেল ৩টা ৪ মিনিটে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয় খালেদা জিয়ার জানাজা। জানাজায় ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্য, বিএনপির শীর্ষ নেতারা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং বিদেশি অতিথিরা। পুরো আয়োজন পরিচালনা করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। দুপুর ৩টা বেজে ৫ মিনিটে জানাজা সম্পন্ন হয়।

জানাজা শুরু হওয়ার আগে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে তাঁর ছেলে তারেক রহমান বলেন, ‘আমি মরহুমা খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান। মরহুমা বেগম খালেদা জিয়া জীবিত থাকা অবস্থায় যদি আপনাদের কারো কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি সেটা পরিশোধের ব্যবস্থা করবো, ইনশাআল্লাহ।’

তারেক রহমান আরো বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) জীবিত থাকা অবস্থায় উনার কোনো ব্যবহারে, কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। দোয়া করবেন, আল্লাহতায়ালা যেন তাঁকে বেহেশত দান করেন।’

খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। আরো উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আসিফ নজরুল ও আদিলুর রহমান খান, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।

খালেদা জিয়ার নিজ দলের মধ্যে ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনসহ দলটির নেতাকর্মীরা।

আরো উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক প্রমুখ।

এছাড়া মানিক মিয়া এভিনিউতে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া, চীন, ইরান, কাতারসহ ৩২ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাদিকও জানাজায় অংশ নেন। তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে সহমর্মিতা জানান তিনি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকায় এসে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি ভারতের শোকবার্তা তারেক রহমানের কাছে হস্তান্তর করেন।

সকালে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খালেদা জিয়ার মরদেহ আনা হয় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে। সেখানে সকাল থেকেই নেমে আসে শোকার্ত মানুষের ঢল। ভোর থেকেই লাখো মানুষ অবস্থান নেয় জাতীয় সংসদ ভবনসংলগ্ন এলাকায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনস্রোত রূপ নেয় জনসমুদ্রে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক, বাস, ট্রেনযোগে ছুটে আসেন সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা। কারো হাতে কালো ব্যাজ, কারো চোখে অশ্রু— সবার বুকে একটাই বেদনা, একজন আপসহীন দেশনেত্রীকে হারানোর শোক।

বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটের দিকে রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলে বেগম জিয়ার মরদেহ বহনকারী প্রিজন ভ্যান যখন জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এসে থামে, মানিক মিয়া এভিনিউ ছাপিয়ে জনস্রোত তখন আছড়ে পড়েছে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে। এই জানাজায় জনসমুদ্র শব্দটিও যেন বিশালতার কাছে হার মেনেছে। অনন্ত যাত্রায় খালেদা জিয়াকে শেষ বিদায় জানাতে তখন কেবলই শোকার্ত মানুষের ঢল।

খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত ব্যানার হাতে নেতাকর্মীরা বলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সেই ধারাবাহিকতায় আগামীতে তারা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মাঝেই প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খুঁজে নেবেন।

সরেজমিন দেখা যায়, সংসদ ভবন এলাকা ছাড়িয়ে যায় জানাজা। সংসদ ভবন এলাকা থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সড়কে বিপুলসংখ্যক মানুষ জানাজায় অংশ নেন। জানাজাস্থলে উপস্থিত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দলীয় নেতাকর্মীদের চোখ ছিল অশ্রুসজল। প্রিয় নেত্রীকে হারানোর বেদনায় অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন, কেউ বিলাপ করেছেন, নীরবে চোখ মুছেছেন। আবার কারো কণ্ঠে কান্নাজড়িত দোয়া। সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, ‘দেশে এমন জানাজা এর আগে আর দেখেনি কেউ।’

মানুষের চাপ সামাল দিতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার প্রবেশপথ খুলে দেওয়া হয়। দক্ষিণ প্লাজার দু’টি বড় মাঠ জানাজার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে লাখো মানুষ সেখানে অবস্থান নেয়। জানাজা নির্বিঘ্ন করতে মানিক মিয়া এভিনিউসহ পুরো এলাকায় মোতায়েন করা হয় ২৭ প্লাটুন বিজিবি। পুলিশ, এপিবিএন, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীসহ ১০ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করেন।

এর আগে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে সকাল ৯টা ১৭ মিনিটের দিকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো একটি গাড়িতে করে খালেদা জিয়ার মরদেহ গুলশান এভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে স্বজন ও নেতা-কর্মীরা তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান। এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মায়ের কফিনের পাশে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখা যায়।

বেলা ১১টা ৫ মিনিটে গুলশান এভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাসা থেকে খালেদা জিয়ার মরদেহ নিয়ে বড় ছেলে তারেক রহমান জানাজাস্থল জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার উদ্দেশ্যে রওনা হন। গাড়িবহরে লাল সবুজ রঙের বাসটিও ছিল। তারেক রহমান, তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমান, ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা জানাজাস্থলে যান।

৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২৩ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ৩৭ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে ইন্তেকাল করেন তিনি।

দীর্ঘ বন্দিদশায় শরীর ও মন ভেঙে পড়েছিল এই আপসহীন নেত্রীর। একসময় ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়েছিল তাঁকে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের পর তিনি বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হন। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। সেখানে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়, বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করেন। ৬ মে দেশে ফেরার দিন বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘিরে নেমে এসেছিল জনতার ঢল। কিন্তু বয়স ও জটিল রোগ বারবার তাঁকে কাবু করে ফেলছিল। শেষ পর্যন্ত ২৩ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৩৭ দিনের লড়াই শেষে তিনি মেনে নেন পরম সত্য।

রাজনীতি বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর