ঢাকা, ২৯ মার্চ শুক্রবার, ২০২৪ || ১৫ চৈত্র ১৪৩০
good-food
৩৩৪

করোনা : সতর্কতায় কমবে ঝুঁকি

ড. অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৮:১৯ ১৫ মার্চ ২০২০  

ড. অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ  :  বিশ্বজুড়ে করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে তিন বাংলাদেশির আক্রান্ত হওয়ার পর ভাইরাসটি প্রতিরোধ এখন আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয়।

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।

৮ মার্চ ভাইরাসটি তিন বাংলাদেশির শরীরে শনাক্ত হয়েছে বলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ঘোষণার পর থেকেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সে জন্য ঝুঁকি কমাতে নানা ধরনের সতর্কতার কথা চিকিৎসকরা বলেছেন। কোনো সুস্থ ব্যক্তি যখন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেওয়া হাঁচি বা কাশির সূক্ষ্ণ কণা শ্বাস-প্রশ্বাস বা হাতের স্পর্শের মাধ্যমে মুখে নেন, তখন তার দেহেও করোনা সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

বিশ্বজুড়ে যেসব সতর্কতার কথা বলা হয়েছে, তার অনেক কিছুই হয়তো আমাদের মেনে চলা কঠিন হবে। কারণ আমাদের জনসংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ ঘন বসতিপূর্ণ দেশ। আপনি চাইলেই জনসমাগমস্থল এড়াতে পারবেন না। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই যেহেতু জনসংখ্যা একেবারে কম; তারা সহজেই জনসমাগম এড়িয়ে চলতে পারে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সূক্ষ্ণ কণা শ্বাস-প্রশ্বাস বা হাতের স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাত ঘন ঘন সাবান বা জীবাণুনাশক দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেখানে-সেখানে কফ ও থুতু না ফেলা, হাত দিয়ে নাক-মুখ ও চোখ স্পর্শ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনাসহ হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ টিস্যু বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছে। মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে, যাতে তার নাক-মুখ ঢেকে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ ব্যক্তি থেকে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখবেন। তার পরও সতর্কতার জন্য সবাই মাস্ক ব্যবহার করছে।

আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে করোনা রোগী পাওয়া গেছে - এ খবর শোনার পরই মানুষ মাস্ক ও জীবাণুনাশক কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এ 'সুযোগে' এক দল ব্যবসায়ী যা কামানোর কামিয়ে নিয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের পাঁচ টাকার মাস্ক বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়। ২০-৩০ টাকার মাস্ক একশ'-দুইশ' টাকায়ও মানুষ কিনতে বাধ্য হয়েছে। এ চিত্র যেমন রয়েছে, অর্থাৎ পণ্যের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে দাম বাড়িয়ে দেওয়া। তেমনি আমাদের অনেকেই স্বার্থপরের মতো 'কেবল আমাকেই বেঁচে থাকতে হবে' - এ ধারণা থেকে হয়তোবা এ দাম বৃদ্ধি ও সংকটের মধ্যেও করোনা প্রতিরোধী এসব স্বাস্থ্যসামগ্রী কয়েক গুণ বেশি দিয়েও কিনেছে।

সেদিন আমি এক বাসায় গিয়ে দেখি, তার বাসায় ১৫/২০টি হ্যান্ডওয়াশ। এমন চিত্র দেখেছি পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও। পেঁয়াজের দাম যখন ২২০ টাকায় ওঠে, ধানমন্ডির এক ব্যক্তি তখন একাই ২০ কেজি পেঁয়াজ কিনে রাখে। হয়তো সে ভেবেছিল, পেঁয়াজের দাম কয়দিন পর পাঁচশ'তে গিয়ে ঠেকে কিনা। এ হলো আমাদের মানসিকতা।

আমরা মাস্ক নিয়ে ঠিকই হুড়োহুড়ি করছি, কিন্তু এটি ব্যবহারের সঠিক নিয়ম অনেকের জানা নেই। দেখেছি, একজন একটা মাস্ক এক মাস ধরে পরছে। অথচ মাস্ক তো এতদিন ধরে ব্যবহারের নিয়ম নেই। মাস্ক একবার ব্যবহারের জিনিস। তা ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কভিড-১৯-এর লক্ষণ (বিশেষ করে কাশি) দেখা দিলেই কেবল মাস্ক পরুন। এ ছাড়া কভিড-১৯ থাকতে পারে, এমন কারও সংস্পর্শে থাকলেও মাস্ক পরুন। অসুস্থ না হলে বা অসুস্থ কারও দেখাশোনার দায়িত্বে না থাকলে মাস্কের ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়। জ্বর বা কাশির মতো লক্ষণ যাদের রয়েছে, তারা এবং কেবল স্বাস্থ্যকর্মী ও পরিচর্যাকারীদেরই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

আমি মনে করি, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিশ্বে সাধারণ ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাকে যত মানুষ মারা যায়, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা তার চেয়েও কম। এমনকি সাধারণ যে ফ্লু, মানে সর্দি-কাশি-জ্বর ইত্যাদিতে যত মানুষ মারা যায়; করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা তার ধারেকাছেও নেই। অথচ এসবের প্রতিষেধক, চিকিৎসা সবই রয়েছে।

তাছাড়া যারা সুস্থ-সবল; এ ভাইরাসে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও কম। মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে বিশেষত বৃদ্ধদের। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত কোনো শিশুর মৃত্যু হয়নি বললেই চলে। এমনকি ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের মৃত্যুর হার ১ শতাংশেরও কম। ৭০-৮০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স্কদের করোনায় মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অথচ আমাদের দেশের মানুষের গড় বয়স ৭৩ বছরের কম। ফলে বয়স্ক ব্যক্তিদের বাস যেসব দেশে, সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কারণ বয়স্কদের শরীরের যে কোনো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাদের ফুসফুস, কিডনি, হার্ট ঠিকমতো কাজ করে না বলে ভাইরাস আক্রমণ করলে রেহাই পাওয়া সম্ভব হয় না।

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, বাংলাদেশের যে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে দু'জনই সুস্থ হয়ে গেছে বলে আইইডিসিআর জানিয়েছে।

আমি মনে করি, এ বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা উচিত। বিশ্বব্যাপী কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, সে হিসাবের চেয়ে কত মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে, সেটিও ভালোভাবে সামনে আনা উচিত।

কয়েক দিন আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যে উহান শহরে, সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গিয়েছেন। কারণ সেখানকার করোনায় আক্রান্ত অধিকাংশই সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে। এমনকি চীনের উহান শহরের একটি অস্থায়ী হাসপাতাল থেকে সব রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর স্বাস্থ্যকর্মীদের নৃত্য করার ছবিও সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

আমি মনে করি, ভাইরাস একটি সাধারণ বিষয়। মানে এ থেকে আমাদের রক্ষা নেই। সময়ে সময়ে ভাইরাস নানা ফর্মে নানান নামে আমাদের সামনে হাজির হয়। এমনকি ভবিষ্যতেও এমন ভাইরাসের উপস্থিতি আমরা দেখতে থাকব। এসব ভাইরাস হয়তো কোনোটা বিশ্বব্যাপী নাড়া দেবে। বিশ্বের অর্থনীতিকেও ধসিয়ে দিতে পারে এমন ভাইরাস। সেদিক থেকে বিশ্বে করোনার প্রভাবও কম নয়। এ পর্যন্ত ৭০ দিনে ১১৭ দেশ ও অঞ্চল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো যাতায়াত। প্রতিদিনই মানুষ প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বিমানে যাতায়াত করছে। যাতায়াত একেবারে ঠেকানো যেমন সম্ভব নয়; তেমনি ভাইরাসও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

তারপরও বহির্বিশ্ব থেকে ভাইরাস যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে সে ঘাটতিই আমরা বরাবর দেখে আসছি। বাংলাদেশে আক্রান্ত তিনজনের দু'জনই ইতালিফেরত। তৃতীয়জনও এদের সংস্পর্শে আশায় আক্রান্ত। তারা কেন বিমানবন্দরে ধরা পড়ল না? ইতালি থেকে আসার পর তাদের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিলে তারা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করলে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। বিমানবন্দরে শনাক্ত না হওয়ার বিষয়ে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাদের সে মুহূর্তে উপসর্গ ছিল না। এটা একটা যুক্তি হতে পারে। কিন্তু এটা হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে, বিমানবন্দরে তাদের করোনা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হওয়া।

আমরা দেখেছি, বিদেশফেরত অনেকেই অভিযোগ করেছে, তাদের করোনাভাইরাস রয়েছে কিনা, সেভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি মঙ্গলবার সংবাদপত্রের খবর - যাত্রীর চাপে বিকল তৃতীয় থার্মাল স্ক্যানারটিও।

অবশেষে আমরা মনে করি, সতর্কতায় কমবে ঝুঁকি। এ জন্য সতর্কতার বিকল্প নেই।

 

# ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ  :  অধ্যাপক, ফার্মাসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

মুক্তমত বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর