ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৩৮৭

করোনায় আক্রান্ত ট্রাম্প, কী হবে আমেরিকার?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:১৫ ২ অক্টোবর ২০২০  

ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকানদের বলেছিলেন করোনা নিয়ে বেশি চিন্তা না করতে। কারণ তার মতে, এ ভাইরাসে আসলে প্রায় কারোরই কিছু হয় না, শুধু বয়স্ক ও হৃদরোগীদের ছাড়া। এ কথা বলার এক সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ ধরা পড়ল। শুধু তিনি নন, ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ।

 

আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এর মাত্র ৩২ দিন আগে নিঃসন্দেহে এটি মারাত্মক ঘটনা। সেই গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ট্রাম্পকে এখন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। চিকিৎসা নিতে হবে। তার নির্বাচনী সমাবেশে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। দুই সপ্তাহের মধ্যে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর দ্বিতীয় টেলিভিশন বিতর্ক হওয়ার কথা। সেটি আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ট্রাম্প-মেলানিয়া করোনা পজিটিভ হওয়ায় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ গত ক’দিন তাকে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে দেখা গেছে। 

 

যদি ট্রাম্প গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, দলীয় নির্বাচনী প্রচারণার কী হবে? তার অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনার কী প্রভাব পড়বে নির্বাচনে? যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন কী ঘটবে? যদি পেন্সেরও কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে, তখন কী হবে? নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কী সাংবিধানিক সংকটের মুখে? এরকম হাজারো প্রশ্ন উঁকি মারছে। সেসবের উত্তর অনুসন্ধানে প্রয়াস চালানো হলো-

 

এ খবরে যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার মাঝখানে এ খবর শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে। বিশ্বনেতারা এরই মধ্যে ট্রাম্পের সুস্থতা কামনা করে বার্তা পাঠিয়েছেন। ট্রাম্প-মেলানিয়ার আশু আরোগ্য কামনা করে বার্তা পাঠিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু।

 

এ সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের শেয়ারবাজারে বড় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এটি শুধু বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের ব্যাপারেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। জাপানের নিকেই শেয়ার সূচক শূণ্য দশমিক সাত শতাংশ পড়ে গেছে। ইউরোপে লন্ডন, ফ্রাংকফুর্ট এবং প্যারিসের শেয়ারবাজারের সব প্রধান সূচকে দর পড়তে থাকে লেনদেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের ডাউ জোনস, নাসডাক ও এসএনপি-তিনটি সূচকেই একই প্রবণতা দেখা যাবে বলে আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা।

 

করোনা মহামারির মধ্যে ট্রাম্প যেভাবে অবাধে মেলামেশা করেছেন, বড় নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন, সেটি নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ ছিল। বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা জন সোপেল বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মারণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা। কিন্তু আবার অবাক হওয়ার মতো কোনও ব্যাপার নয়। তার মতে, এটি এ কারণেই অত্যাশ্চর্য খবর, ট্রাম্পকে ঘিরে নেয়া সব ব্যবস্থার পরও তিনি আক্রান্ত হলেন। তাকে ঘিরে নিরাপত্তার তুলনীয় আর কিছু নেই। যারা ঘিরে রাখেন, তাদের সারাক্ষণ করোনা পরীক্ষা করা হয়।

 

জন সোপেল বলছেন, ট্রাম্প প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাতে আবার অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ করোনার নিয়মকানুনের ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের কর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে ওয়েস্ট উইং-এ বেশ অনীহা দেখা গেছে। সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন ছাড়া হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং-এ খুব কম লোকই মাস্ক পরেন।

 

নির্বাচনী প্রচারণার যা হবে
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা এদিন থেকে নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেল। এটা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। এ ঘটনার পর ট্রাম্পকে নির্বাচনী সমাবেশগুলো বন্ধ রাখতে হবে। তিনি আর আগের মতো সবকিছু করতে পারবেন না। সেটা উনার উপদেষ্টারাও স্বীকার করছেন। শুক্রবার রাতে তার থাকার কথা অরল্যান্ডোর নির্বাচনী সভায়। এ সপ্তাহ শেষে যাওয়ার কথা উইসকনসিন। এসব সমাবেশ এখন আর সামনাসামনি হওয়ার সুযোগ নেই।

 

দুই সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেনের মধ্যে দ্বিতীয় টেলিভিশন বিতর্ক হওয়ার কথা। প্রথম বিতর্কটি যেরকম বিশৃঙ্খল ছিল, তা নিয়ে সমালোচনার পর বিতর্কের নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা কোন দিকে যায়, সেটার ওপর এ বিতর্কের ভাগ্য নির্ভর করছে। ট্রাম্পের একজন উপদেষ্টা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এমন হতে পারে-কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রেসিডেন্ট সামনাসামনি বিতর্কের পরিবর্তে ভার্চুয়ালি অংশ নিতে পারেন।

 

এর রাজনৈতিক সুবিধা কে পাবে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থার ওপর। যদি তিনি 'এসিম্পটোমেটিক' হন। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে যেসব গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলো যদি তার না থাকে, তাহলে হয়তো আবারও ভাইরাসটি সেরকম গুরুতর কোনও ব্যাপার নয়, সেই বার্তা দেয়ার চেষ্টা করবেন। আবারও বলার চেষ্টা করবেন, এটা নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে।

 

আবার যদি ট্রাম্প গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেটা থেকেও তিনি রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারেন। সেজন্য সহানুভূতির ঢেউ উঠতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ অসুস্থতা থেকে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ক্ষেত্রে তার বিরোধী শিবিরের লোকজনকেও বেশ সতর্ক থাকতে হবে। 

 

মারণ রোগের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছিলেন, ট্রাম্প আগাগোড়া সেগুলো উপেক্ষা করেছেন। অনেকক্ষেত্রে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। মহামারির মধ্যেই তিনি বড় বড় নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে নিয়মিত নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এখন ট্রাম্পের বিরোধী শিবিরের লোকজন যদি বলার চেষ্টা করেন, প্রেসিডেন্ট তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন, সেটাকে রিপাবলিকানরা কাজে লাগাতে পারে বিরোধীপক্ষের ‘হৃদয়হীনতা এবং সুবিধাবাদিতার’ উদাহারণ হিসেবে। 

 

আবার এ ঘটনা করোনাকে ফের বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। সেটি ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্ষতি করতে পারে, যেটি তিনি চাইছিলেন না। এর উল্টোটাও হতে পারে। তার সমর্থকরা প্রেসিডেন্টের পক্ষে আরও বেশি করে জোট বাঁধতে পারে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এরিক হ্যাম বলেন, এর দুটিই ঘটতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো চাইবেন-ট্রাম্প, ফার্স্ট লেডি এবং আক্রান্ত সবাই সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু আবার এটাও মনে রাখতে হবে, এ প্রেসিডেন্ট করোনা সম্পর্কে ভুল তথ্যের সবচেয়ে বড় উৎস ছিলেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত রিপোর্টে সেরকমই দাবি করা হয়েছে। তিনি শরীরে ব্লিচ ইনজেক্ট করা থেকে শুরু করে কত রকম কথা যে বলেছেন। এখন ট্রাম্প নিজেই বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে  করোনা আক্রান্ত। কাজেই এটি তার বিপক্ষেও যেতে পারে।

 

ট্রাম্প দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে যা ঘটবে

হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের চিকিৎসক বেশ আশাবাদী। তিনি মনে করেন, প্রেসিডেন্ট কোনও বিঘ্ন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, করোনা আক্রান্ত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই অবস্থা দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করে। লোকজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

 

ট্রাম্পের বয়স ৭৪ বছর। হোয়াইট হাউজের চিকিৎসকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি শারীরিকভাবে স্থূলকায়। অর্থাৎ উচ্চতা অনুযায়ী তার যা ওজন থাকা উচিৎ, সেটার চেয়ে বেশি। এসব কিছুর কারণে উনি সেই দলে পড়েন, যাদের জন্য করোনা আক্রান্ত হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে যান, তখন কী করতে হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে মার্কিন সংবিধানে।

 

জন সোপেল বলেন, দেশটির সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীতে বলা আছে অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্ট অক্ষম হয়ে পড়লে দায়িত্ব নেবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। সুতরাং ট্রাম্পের কিছু হলে পেন্সকেই তার জায়গা নিতে হবে। সেজন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে হয়তো ওকে অল্প কিছুদিনের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে।

 

২৫তম সংশোধনীর এ ধারায় উল্লেখ আছে, প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে সাময়িকভাবে তার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে। যখন আবার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন, তখন ফের এ ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে পারেন।

 

কিন্তু পেন্সও যদি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য এর পরেই আছেন হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া খবরে বলা হচ্ছে, পেলোসি এরই মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আইসোলেশনে গেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তিনি হচ্ছেন বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির। কাজেই তার কাছে ক্ষমতা যাওয়ার মানে হচ্ছে রিপাবলিকানদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ডেমোক্রেটদের হাতে চলে যাওয়া। 

 

ওয়াশিংটন পোস্ট এরকম পরিস্থিতির কথা কল্পনা করে এ বছরের শুরুতে লিখেছিল, ট্রাম্প ও পেন্সের কাছ থেকে পেলোসির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের যেকোনও চেষ্টার বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই অনেক আইনি এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসবে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দরকার খুব বেশি, তখন এ ঘটনা সেখানে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। কাজেই এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে এসব ঘটনায় মার্কিন মুলুকে সাংবিধানিক সংকটের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর