ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৫৯৫

গোপন আস্তানায় ইলেকট্রিক শক্ মেশিন

কী নেই খালেদের টর্চার সেলে!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:৫২ ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

কমলাপুরে যুবলীগ নেতা খালেদের একটি ডেরা রয়েছে। সেখানে তিনি যান বিশেষ বিশেষ সময়ে। নিতান্তই ব্যক্তিগত কাজে। র্যাবের দল সেই আস্তানার খোঁজে অভিযান চালায়। আস্তানার খোঁজও মিলে যায়। গত বুধবার গ্রেফতারের পর ব্যাপক জেরার মুখে খালেদ তার এই আস্তানার তথ্য দেয় র্যাবের কাছে। 

রাজধানীর কমলাপুরের রেল স্টেশনের ঠিক উল্টো দিকে ইস্টার্ন কমলাপুর টাওয়ার। সেই টাওয়ারের চতুর্থ তলাতেই মিলে গেল ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার আস্তানা। র্যাবের দল সেখানে ঢুকেই হতবাক। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ধরনের মোটা লাঠি, বেসবল খেলার ব্যাট। একটি বিশেষ গোপন কক্ষে ঢুকেই আবিষ্কার করে এক ভয়ঙ্কর টর্চার সেল। টর্চারের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি দেখে র্যাব কর্মকর্তারা আঁতকে ওঠেন। দুটি ৫ ভোল্টের ইলেকট্রিক শক দেওয়ার যন্ত্র। রয়েছে আরও নানা যন্ত্রপাতি। 
অত্যাচারের কায়দাকানুন এবং যন্ত্রপাতি দেখে র্যাব কর্মকর্তারা নিশ্চিত যে, এখানেই মানুষজনকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করত খালেদ। চাঁদা দিতে কোনো ব্যক্তি অস্বীকৃতি জানালে তাকে এ টর্চার সেলে এনে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। অভিযানে অংশ নেওয়া একজন সদস্য জানান, ওই টর্চার সেলের কক্ষের দেয়ালের কিছু স্থানে ছোপ ছোপ রক্তের দাগও মিলেছে।  
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, খালেদ অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতারের পর আমরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টর্চার সেলের সন্ধান পাই ও অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে টর্চার সেল থেকে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, গায়ের চামড়া জ্বলে-জ্বালাপোড়া করে এমন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, বিপুল পরিমাণ লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক দেখতে পাই। সেগুলো আমরা জব্দ করি। তিনি বলেন, এখানে যা দেখছি লোম শিউরে ওঠার মতো অবস্থা।
র্যাব জানায়, টর্চার সেলে নির্যাতনের অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। উচ্চ মাত্রায় সুদসহ পাওয়া টাকা আদায় সব ধরনের কাজে ব্যবহার করা হতো এই টর্চার সেল। রাত গভীর পর্যন্ত খালেদের টর্চার সেলে অভিযান চলমান রয়েছে। এখানে যা দেখছি লোম শিউরে ওঠার মতো অবস্থা হয়েছে আমাদের।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপপরিচালক মেজর হুসাইন রইসুল আজম মনি বলেন, খালেদের অফিসে অভিযান চালিয়ে ইলেকট্রিক শক মেশিন ২টি, লাঠি ৫টি, অস্ত্রের তেলের বোতল ২টি, ইয়াবা ১৯০ পিস, বিয়ার ৫ ক্যান, সিসা ৭০০ গ্রাম, সিসা খাওয়ার কয়লা দেড় কেজি, মোবাইল ৩টি, ল্যাপটপ ২টি ও নগদ ২৩ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

র্যাবের হাতে গ্রেফতার ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। মতিঝিল-ফকিরাপুল ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো থেকে শুরু করে কমপক্ষে সাতটি সরকারি ভবনে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি জমি দখলের মতো নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। 
২০১২ সালের পর ঢাকার এক অংশের নিয়ন্ত্রণ আসে খালেদের হাতে। নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করেন তিনি। অভিযোগ থেকে জানা যায়, রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন এই যুবলীগ নেতা। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়াং ম্যানস নামের ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করেন। প্রতিটি ক্লাব  থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ টাকা নেন তিনি। এসব ক্লাবে সকাল ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যাসিনোতে চলে জুয়া। সেখানে মাদকের ছড়াছড়ি। পাওয়া যায় ইয়াবাও।
খিলগাঁও-শাহজাহানপুর হয়ে চলাচলকারী লেগুনা ও গণপরিবহন থেকে নিয়মিত টাকা দিতে হয় খালেদকে। প্রতি কোরবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে প্রতিদিন রাতে মাছের একটি হাট বসান এই নেতা। সেখান থেকে মাসে কমপক্ষে এক কোটি টাকা আদায় করেন তিনি। একইভাবে খিলগাঁও কাঁচাবাজারের সভাপতির পদটিও দীর্ঘদিন তিনি ধরে রেখেছেন। শাহজাহানপুরে রেলওয়ের জমি দখল করে দোকান ও ক্লাব নির্মাণ করেছেন।
যুবলীগ নেতা খালেদের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি শান্তিনগরের হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছেন। ওই সময় কলেজে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে পুলিশের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের গুলিতে তার একটি পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই থেকেই তাকে ল্যাংড়া খালেদ নামে অনেকে চেনে। ১৯৮৭ সালে ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর নেতৃত্বে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা হয়। এ দুই নেতার হাত ধরেই খালেদের উত্থান। ২০০২ সালে বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন খালেদ। ২০১১ সালে মোহাম্মদপুরে ঢাকা মহানগর উত্তরে সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন বাবু ওরফে লীগ বাবু খুন হন। ওই খুনের সঙ্গে খালেদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।


রাজধানীর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে ‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর গুলশানের নিজ বাসা থেকে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এসময় তার বাসা থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি, ২০১৭ সালের পর নবায়ন না করা একটি শটগান ও ৫৮৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে গুলশান থানায় নেয় র্যাব। সেখান থেকে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। অস্ত্র মামলায় ৪ দিন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় খালেদের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা দুটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি, উত্তর) স্থানান্তর করা হয়েছে। ডিবি কার্যালয়েই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গেল ১৪ সেপ্টেম্বর  যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চার দিনের মাথায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। ক্যাসিনোতে অভিযান চলাকালেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। খালেদসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় পরিচালনাধীন চারটি ক্যাসিনো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। অভিযানে মোট ১৮২ জনকে আটকের পর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া জব্দ করা হয়েছে বিপুল অংকের টাকা, মদ ও বিয়ারসহ জুয়া খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম।