ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৭১২

কীভাবে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:৫৮ ২৯ জানুয়ারি ২০২০  

সারাবিশ্বে গেল ৩০ বছরে ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার ঘটনা বেড়েছে। এর ফলে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসুখ। এখন এরকমই এক করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে চীনে। যেটি খুব দ্রুত দেশটির বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি সীমান্তের বাইরেও বিস্তার ঘটছে।
কিন্তু কেন এত দ্রুত ছড়াচ্ছে এ করোনা ভাইরাস? পৃথিবীতে এখন মানুষের সংখ্যা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্ব জনসংখ্যা বর্তমানে ৭৭০ কোটি। এ সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমন মানুষ এখন একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি বসবাস করছে।
অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বাস করার অর্থই হলো জীবাণুর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখের সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে মানুষ থেকে মানুষে, তাদের হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে।
মানুষের দেহের বাইরে এ ভাইরাসটি খুব অল্প সময় বেঁচে থাকতে পারে। ফলে ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে হলে তাদের কাছাকাছি থাকতে হবে।
ইবোলা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ২০১৪ সালে। সেবার এটি ছড়িয়েছিল রক্ত কিংবা শরীর থেকে নির্গত অন্য কোনও তরল পদার্থের মাধ্যমে। ফলে রক্তদান ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।
 

মানুষের ঘনবসতি
সব ভাইরাস কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। এমনকি জিকা ভাইরাসও, যা মানুষের শরীরে আসে মশা থেকে। সেটাও লোকজন ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করলে ছড়াতে পারে। যেসব এলাকায় মানুষের ঘনবসতি, সেখানে জিকা ভাইরাস-বাহী মশা মানুষের রক্ত খেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের জন্মের বিস্তার ঘটে আদ্র, স্যাঁতসেঁতে ও উষ্ণ পরিবেশে।
২০০৭ সালের পর থেকে শহরাঞ্চলে মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এরকম এলাকা পৃথিবীর মোট জমির মাত্র এক শতাংশ। কিন্তু এইটুকু জায়গাতেই বাস করে ৪০০ কোটিরও বেশি মানুষ। শুধু তাই নয়, লোকজন এখন এমন শহরের দিকে ছুটে যাচ্ছে; যেগুলো এখনও বসবাসের জন্যে প্রস্তুত নয়।
ফলে অনেক মানুষের আশ্রয় হয় বস্তি এলাকায়, যেখানে পরিষ্কার খাবার পানি নেই, পয়-নিষ্কাশন ব্যবস্থাও খুব খারাপ। ফলে এরকম পরিবেশে খুব দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
 

গণ-পরিবহন
এছাড়া সংক্রামক ভাইরাস শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে পরিবহনের মাধ্যমে। বিমান, রেল, গাড়িতে করে এখন ভাইরাস পৃথিবীর অর্ধেক দূরত্বও পাড়ি দিতে পারে একদিনেরও কম সময়ে।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি পাওয়া গেছে কমপক্ষে ১৬টি দেশে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিমানে চলাচল করেছে ৪৫০ কোটি যাত্রী। কিন্তু মাত্র ১০ বছর আগেও তাদের সংখ্যা ছিল ২৪০ কোটি।
চীনে দ্রুতগতির যে ট্রেন চলে, সেটার প্রধান একটি স্টেশন উহান। এ শহরটি থেকেই ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। তাছাড়া এ ভাইরাস এমন সময়ে দেখা দিয়েছে, যখন দেশটির কোটি কোটি মানুষ তাদের নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় ছুটিতে সারাদেশে ভ্রমণ করছে। চীনা নববর্ষের সময় সাধারণত সারাদেশে ৩০০ কোটি বারেরও বেশি ট্রেন চলাচল করে থাকে।
 

৫ থেকে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ১৯১৮ সালে। ওই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি পরিচিত স্প্যানিশ ফ্লু নামে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, মানুষ যখন ইউরোপের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছিল, তখনই ওই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভাইরাসটি যখন ছড়াচ্ছিল, তখন সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছিল যার যার নিজেদের দেশে। একই সঙ্গে তারা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জাও। এ ভাইরাস তারা এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে তখনও ভাইরাস প্রতিরোধী কোনও ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছেও ওই ভাইরাসটি ছিল একেবারেই অচেনা ও নতুন।

ভাইরোলজিস্ট জন অক্সফোর্ডের একটি গবেষণা অনুসারে, ওই ভাইরাসটির উৎস ছিল একটি ক্যাম্প, যেখান দিয়ে প্রতিদিন এক লাখের মতো সৈন্য অতিক্রম করেছে। সেসময় বিমান চলাচলেরও তেমন কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তবুও ওই ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ধারণা করা হয়, ওই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে সময় নিয়েছিল ৬ থেকে ৯ মাস। আর বর্তমানে যখন আমরা মাত্র একদিনেই সারা পৃথিবী ঘুরে আসতে পারি, সেখানে তো এ ভাইরাস আরো অনেক দ্রুতগতিতেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
 

পশুপাখি ও মাংসের চাহিদা
ইবোলা, সার্স এবং এখনকার করোনা ভাইরাস - এগুলো সবই জুনোটিক ভাইরাস। এগুলো প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে মানবদেহে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাসটি হয়তো সাপ থেকেই এসেছে। আজকের দিনে যতো অসুখ আছে তার চারটির প্রায় তিনটিই হয় জুনোটিক ভাইরাসের কারণে।
সারা বিশ্বেই খাদ্য হিসেবে মাংসের চাহিদা বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পশুপাখির চাষও। ফ্লু ভাইরাস সাধারণত গৃহপালিত পশুপাখি থেকেই মানুষের দেহে ছড়ায়। ফলে মানুষের এখন আক্রান্ত পশুপাখির সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিও বেড়ে গেছে।
করোনা ভাইরাস মানবদেহে এসেছে বন্যপ্রাণী থেকে। চীনে জনবহুল এলাকাতেও আছে এসব প্রাণীর বাজার। এ থেকেও বোঝা যায়, চীনে ভাইরাসটি কীভাবে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। এছাড়া শহরের আকার বেড়ে যাওয়ায় লোকজন গ্রামীণ এলাকায় চলে আসায় তারা বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসছে বেশি। এরকমভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে লাসা জ্বর। 
গাছপালা কেটে মানুষ যখন সেখানে চাষাবাদ করছে, তখন সেখান থেকে ইঁদুর মানুষের বাড়িঘরে চলে আসছে। সেগুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসছে লাসা জ্বর। পৃথিবীর এক জায়গা এখন আরেক জায়গার সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত। কিন্তু সারা পৃথিবীতে একসঙ্গে কাজ করবে এরকম সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনও।
এ প্রকোপ ঠেকাতে ভাইরাসটি যেদেশে উৎপত্তি হয়েছে, আমরা সেদেশের সরকারের ওপরেই নির্ভর করি। তারা ব্যর্থ হলে সারা পৃথিবীর মানুষ ঝুঁকিতে পড়ে যায়। পশ্চিম আফ্রিকায় গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়ন যখন ইবোলা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলো, তখনই সেটা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ল।
পশ্চিম আফ্রিকাতে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১,৩১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সৌভাগ্য যে, ওই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল তুলনামূলকভাবে অনেক ধীরগতিতে। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনা ভাইরাসের মতো ভাইরাস, যা শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায়, সেগুলো অনেক বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
 

স্বাস্থ্যসেবা ও বিনিয়োগ
দরিদ্র এলাকাতে যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খারাপ, সেখানে এটি দ্রুত ছড়াবে। শিক্ষা, সচেতনতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পয়-নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব হলে এ ঝুঁকি আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে এসব দেশ থেকে স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ লোকেরা অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
এছাড়া যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, সেসব মোকাবেলায় কেউ তাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করতে চায় না। যখন সোয়াইন ফ্লুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল, তখন সারাবিশ্বেই এর ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু ভাইরাসটি ততটা মারাত্মক না হওয়ায় পরে এ উদ্যোগেরও সমালোচনা হয়েছে।
এসব ভাইরাস মোকাবেলায় ওষুধ তৈরির জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রযুক্তি থাকলেও ওষুধ কোম্পানিগুলো এতে বিনিয়োগ করে না। কারণ, এসব ভাইরাসে যদি মাত্র কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয় তা থেকে এ কোম্পানিগুলো বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারে না।
আমরা জানি, ভাইরাসের প্রকোপ ঘটবে। কিন্তু আমরা জানতে পারি না, কখন ও কোথায় এ প্রকোপ দেখা দেবে। এর ফলে কোথাও সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপের খবর আমাদের কাছে সবসময় বিস্ময় হিসেবেই আসে।
তবে সুখবর হচ্ছে, গবেষণায় দেখা গেছে, এখন রোগের প্রকোপ বেশি হলেও এতে অল্প সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। যখন দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, যেমনটা আমরা চীনে দেখছি, সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাও উন্নত হচ্ছে।
কীভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও এড়িয়ে চলা যায়, এর তথ্যও খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চীনের মতো একটি দেশ ১,০০০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে তুলতে পারে মাত্র এক সপ্তাহে। ১৯১৮ সালে এটা ছিল কল্পনাতীত বিষয়।

বিশ্ব বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর