ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১২৪৮

জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ: দরকার গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা

।। অনোয়ার হক।।

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৪:১০ ১৩ জানুয়ারি ২০২২  

জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাস মানবাধিকার ও উন্নয়ন-অগ্রগতির সরাসরি প্রতিবন্ধক। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে এ কথা বলা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পবিত্র ধর্মকে অপব্যবহার করে সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বিপথে নিয়ে যায় তরুণ-যুব সমাজকে। সৃষ্টি করে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা। এসব অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিরোধ দরকার। আর এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে শক্তিশালী গণমাধ্যম।     


 
জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন জাতীয় সমন্বিত উদ্যোগ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ, ব্যাপক প্রচারণা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি। আর এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর ভূমিকা। 


গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দরকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, পরিবার ও ধর্মীয় সমাবেশ - সকল ক্ষেত্রেই জঙ্গি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আলোচনা, দিকনির্দেশনা। 


 
ব্যাপক গণসংযোগের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ সংবাদ, বিশেষ ফিচার-কলাম, পোস্টার, লিফলেট, অনুষ্ঠান, নাটক-সাহিত্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য ইত্যাদি গণমাধ্যম তথা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। 


 
মিডিয়ায় সমন্বিতভাবে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালানো গেলে তা সমাজে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেয়া কার্যক্রমগুলো মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার দরকার। পত্রিকা-রেডিও-টেলিভিশন-অনলাইন মিডিয়া ও সিনেমা-থিয়েটার-নাটকসহ অন্যান্য গণমাধ্যম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 


 
এছাড়া সাংবাদিক সংগঠনগুলোও গ্রহণ করতে পারে ব্যাপক বহুমাত্রিক কার্যক্রম।  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে সুস্পষ্ট জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। ক্রমাগত জনসংযোগ করার ফলে দুর্বল মন:স্তত্ত্বের অধিকারী এবং অর্বাচীন যুবারা স্বার্থান্বেষীর পাতা ফাঁদে পড়া হতে রক্ষা পেতে পারবে। 


 
নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ, বিবিধ পুরষ্কার এবং সামাজিক অনুশাসনের চর্চাও এক্ষেত্রে জরুরি। 


শিক্ষার আমূল সংস্কার করে মুক্তচিন্তা, যুক্তিতর্ক এবং মানবীয় গুণাবলী, মানবতা বা গণতন্ত্র, সাম্য ও সমতার দর্শন শিক্ষা দেয়া হলে তা নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথনির্দেশনা দিতে পারে। আর এজন্য দরকার, ঘৃণা ও পরনিন্দার স্থলে মানবপ্রেম ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা প্রদান।


 
আলোকিত আদর্শের পাশাপাশি দরকার আলোকিত ব্যক্তিবর্গের জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া। দরকার ধর্মীয় ও সামাজিক মুল্যবোধের উদার এবং গভীর স্বরূপ আলোচনা এবং শিক্ষা দান। পাড়া-মহল্লায় গণপাঠাগার স্থাপন এবং সনদের জন্য নয় - শিক্ষাকে তথা জ্ঞানার্জনকে জীবনের অনুষঙ্গ করে তোলা খুবই জরুরি। 


 
পারিবারিক পরিমন্ডলহীন বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব, স্বার্থপরতা, নির্দয়তা, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার, সব স্তরে নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা, বয়ো:জেষ্ঠদের কথা ও কাজের বৈপরীত্য, স্বপ্নহীনতা ও হতাশা, মাদক ও মাফিয়ার ছোবল, মত প্রকাশে বাধাদান ইত্যাদি জঙ্গি-সন্ত্রাস বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়ে থাকে। সমাজে এসবের অবসান জরুরি। 


আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনও আমাদের সমাজকে নানাভাবে কলুষিত করছে। এজন্য এ বিষয়টিতে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে মিডিয়াকর্মীদের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। 

 

জঙ্গি-সন্ত্রাস কবলিত সমাজে ব্যাপক ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য সুযোগের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের অনেক করণীয় রয়েছে। সত্যের সঠিক উপলব্ধি ও সঠিক উপস্থাপন, প্রয়োজনে অধিকতর তথ্যানুসন্ধান, অন্যের বরাতে সম্ভাব্য ভুল ও ভুয়া প্রচার হতে বিরত থাকা দরকার। মিথ্যা-গুজব প্রচার সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ায়। যা সন্ত্রাস সহায়ক। 
জ্ঞানভিত্তিক ও সহনশীল সমাজ নির্মানের জন্য শিক্ষা, দর্শন, মুক্তচিন্তা, যুক্তিতর্ক, মানবীয় মহৎ গুণাবলী, গণতন্ত্র, সাম্য ও সমতার কথা সর্বত্র তুলে ধরা জরুরি। 


 
এক্ষেত্রে সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব বজায় রাখাও খুব জরুরি। জ্ঞানার্জন, পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে একজন গণমাধ্যমকর্মীর উচিত রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সঠিকভাবে কাজ করা। অসত্য তথ্য ও গুজব প্রতিরোধে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।


 
সন্ত্রাসবাদের উৎস অনুসন্ধান করে একদিকে যেমন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে হবে, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদের মহাবিপদের মাত্রা তুলে ধরতে হবে। যাতে পাঠক-দর্শক তথা দেশ ও জাতি সচেতন, সজাগ হতে পারে।  সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক অঙ্গনে যেন মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবর্তে ধর্মীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতার চর্চা না হয়, সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে।  মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান প্রতিরোধে সমন্বিত কাজ করতে হবে।


 
মনে রাখতে হবে, মৌলবাদী-জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কোন ভৌগলিক সীমারেখা নেই।   আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত তারা। এরা শান্তির ধর্ম ইলামের নামে বর্বর হত্যাকাণ্ড করে বিশ্বব্যাপী ইসলাম তথা মুসলমানদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে উন্নয়ন ও সভ্যতাকে ধ্বংস করে অন্ধকারের পথ নির্দেশ করছে। এই অবস্থায় সব প্রগতিশীল গণতন্ত্রকামী দেশেপ্রেমিক জনগণ এবং মিডিয়াকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থেকে সমগ্র দেশ ও জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার নির্দেশক হিসেবে কাজ করতে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের পাশাপাশি সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমেই পারে সব ধরনের প্রতিকূলতা প্রতিরোধ করে জাতিকে এগিয়ে নিতে। 


 
মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে দরকার মনের সুকুমারবৃত্তির পরিচর্যা। হিংসা দিয়ে যে জীবন তৈরি হয়, তাতে আর যা-ই হোক কাঙ্ক্ষিত মানবসভ্যতাকে লালন করা সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন যে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সচেতন প্রয়াস। প্রয়োজন, এর ভয়ংকর পরিণাম সম্পর্কে সর্বস্তরের সামাজিক জাগরণ। প্রয়োজন শক্তিশালী গণমাধ্যমের যথার্থ ও সময়োপযোগী ব্যবহার।


 
লেখক: আনোয়ার হক
সাংবাদিক ও জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ