ঢাকা, ১২ জুলাই শনিবার, ২০২৫ || ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
good-food
৩৪

টানা বৃষ্টিতে ৫ জেলায় জলাবদ্ধতা, বন্যার চোখরাঙানি

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:৪৯ ১০ জুলাই ২০২৫  

দুই দিনের টানা ভারী বর্ষণে ফেনীর প্রায় ৪০টি গ্রামের ১১ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের দেওয়া এ তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত করে স্থানীয়রা বলছেন, পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ২৫ হাজারের কম হবে না। আগের বছরের বন্যার দগদগে স্মৃতির মধ্যে ফেনী ছাড়াও খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, কক্সবাজার ও সাতক্ষীরায় নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে; কোথাও কোথাও বন্যার চোখ রাঙানির মধ্যে মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতেও বাধ্য হয়েছে।

 

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে চলতি পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ফেনীতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। অপরদিকে প্রবল পানির তোড়ে সড়ক প্লাবিত হওয়ায় রাঙামাটির লংগদু সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। খাগড়াছড়ি ও ফেনীতে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে বাসভাসী মানুষ। খাগড়াছড়ির পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে মানুষকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ খাবার নিয়ে আবার পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেই ফিরছে বলে জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানিয়েছেন।

 

এই অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, বৃষ্টিপাত আরও এক-দুদিন ঝরতে পারে। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় হালদা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং চট্টগ্রাম জেলার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যা পরবর্তীতে হ্রাস পেতে পারে। সিলেট বিভাগের মনু, ধলাই ও খোয়াই নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃদ্ধি পাবে।

 

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে; আগামী দুই দিন পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী তিন দিন পর্যন্ত পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে; এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। সুরমা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে ও কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে। এই অববাহিকায় আগামী তিন দিন মাঝারি থেকে মাঝারি-ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

 

ফেনীর ৪০ গ্রাম প্লাবিত

ফেনীর পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি খারাপ। সেখানকার দুটি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, জেলার মুহুরি ও সেলোনিয়া নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় নদী দুটির পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে ও ফেনী জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে, যা পরবর্তীতে হ্রাস পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি লাভ করতে পারে। এই অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টা ভারি ও পরবর্তীতে আরও দুদিন মাঝারি থেকে মাঝারি-ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে।

 

ফেনীতে মঙ্গলবার রাত ১২ পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। বুধবার দুপুর ১২ পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৯৮ মিলিমিটার, বিকাল ৩টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৪১ মিলিমিটার, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বুধবার (৯ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সীমান্তবর্তী মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ২০টি স্থান ভেঙে অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিমত। বাড়ি-ঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন বানভাসিরা। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম।

 

ফেনীতে কমছে বৃষ্টি, বাড়ছে ভাঙন

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ২০টি পয়েন্টে ভেঙেছে। এর মধ্যে ফুলগাজীতে আটটি ও পরশুরামে ১২টি স্থান রয়েছে। তবে দুটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, তিনটি নদীর বেড়িবাঁধের ১৯টি স্থান ভেঙেছে। এর মধ্যে ফুলগাজীতে নয়টি ও পরশুরামে ১০টি স্থান রয়েছে। বাড়ি ঘরে পানি উঠে যাওয়া দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। যাদের ঘরে কোমর থেকে বুক পর্যন্ত পানি তারা অনেকে নিকটস্থ আত্মীয়দের বাসায় বা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন।

 

পরশুরামের ঘনিয়ামোড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল শুক্কুর বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে ঘরে পানি ওঠায় বুধবার সকাল পর্যন্ত ঘরে অবস্থান করেছেন। বুধবার সকাল থেকে পানি বেড়ে যাওয়ায় পানি মাড়িয়ে পরিবহন চড়ে ফেনীতে আত্মীয়ের বাসায় চলে এসেছেন। বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রশাসনের কেউ তাদের কোনো খোঁজখবর নেননি।

ফুলগাজী উপজেলার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে প্রতিবছর এলাকা প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগে পরে স্থানীয়রা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এদিন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলার ৩১৫টি পরিবারের এক হাজার ২৯৭ জন ব্যক্তি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। একই সময়ে ফুলগাজী উপজেলার ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজার ১৭৮ জন আশ্রয় নিয়েছে।

 

আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া বানভাসিদের শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম ও পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল রহমান। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১১ হাজার ৫০০ মানুষ দুর্যোগ কবলিত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন জেলা প্রশাসন।

 

বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক কিছুটা সচল

বন্যা কবলিত ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ কোথাও বন্ধ রাখা হয়েছে, কোথাও স্বল্প পরিসরে দেওয়া হচ্ছে। বিকালের পর থেকে পরশুরামের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ সচল করা হয়েছে। তবে ফুলগাজী উপজেলার অনেক স্থানে এখনো বিদ্যুৎ নেই বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।

 

অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার স্থগিত

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন জানান, বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা কবলিত হওয়ায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাগুলো স্থগিত করা হয়েছে। যে সব বিদ্যালয়গুলো আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত বন্ধ থাকছে। এদিকে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইশতিয়াক আহমদ বলেন, এদিন এমনিতেই প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ গেছে। জরুরি পরিস্থিতির কারণে বৃহস্পতিবারও পাঠদার বন্ধ থাকবে। শুক্র ও শনিবার সরকারি বন্ধ আছে। এরপর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

 

বন্যা কবলিত এলাকার এসব প্রাথমিক বিদ্যালয় বুধবার থেকেই বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক। অপর দিকে সদর, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুল ও মাদ্রাসার চলমান অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা বুধ ও বৃহস্পতিবারের জন্য স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর উদ্দিন জাহাঙ্গীর।

 

বিচ্ছিন্ন লংগদু

খাগড়াছড়িতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রবর বৃষ্টিতে দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেড কোয়ার্টার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ায় রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের নিচু এলাকার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৯ জুলাই সকাল থেকে মেরুং ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠতে শুরু করে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন। এতে চিটাইগ্যাংয়া পাড়া বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ মেরুং বাজার সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে মেরুং বাজার ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

 

নদী উপকূলে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত

নিম্ন চাপের প্রভাবে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা পৌরসভার এক-তৃতীয়াংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া জেলা সদরের নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে পৌর এলাকার অন্তত তিন হাজার পরিবার ভোগান্তিতে পড়েছেন। এদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত এ জেলায় ৩৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ডের করা হয়েছে। এ ছাড়া নদী উপকূলে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

 

আরও তিন দিন বৃষ্টির প্রভাব থাকবে বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন। সকাল ৯টা পর্যন্ত এ জেলায় ৩৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ডের করা হয়েছে। এ ছাড়া নদী উপকূলে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

 

প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে গোমতীর পানি

গোমতী নদীর পানি প্রতি ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে নদীর বাঁধের ভেতরের জমি ও বসতি ডুবতে শুরু করেছে। তবে গোমতীর পানির উচ্চতা বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বিপৎসীমার আড়াই মিটার নিচে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালীউজ্জামান। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) বেলা ৩টা থেকে বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় ১২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

জনদুর্ভোগ বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর