ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৫২৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবস্থার জন্য কারা দায়ী?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:১৮ ২৩ জানুয়ারি ২০২১  

১৯২১ সালের ১ জুলাই শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই উপাচার্য হার্টগ কিছু খ্যাতনামা পণ্ডিতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবং প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ দেন। নতুন উপাচার্য ও নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, জ্ঞান-গরিমা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে সূচনা থেকেই ঢাবি মান-মর্যাদা ও গৌরবের সঙ্গে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। 

 

পূর্ব বাংলার সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় আদালত, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, একাডেমিক কাউন্সিল, অনুষদ ও ইনস্টিটিউট। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯২০-এ একটি নির্বাচিত প্যানেল থেকে উপাচার্য নিয়োগের বিধান রাখা হয়। একইভাবে অনুষদের শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডিন নির্বাচনের বিধানও সংরক্ষণ করা হয় অ্যাক্টে। 

 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হলো এবং প্রাদেশিক সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবধরনের কর্মকাণ্ডে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করা শুরু করল। হুমকির সম্মুখীন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন। প্রাদেশিক সরকার স্বায়ত্তশাসন খর্ব করে ১৯৬১ সালে এক অধ্যাদেশ জারি করল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হতো এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে। 


এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকার নগ্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও বিকাশের কোনো সুযোগ এবং পরিবেশ ছিল না। শিক্ষকসমাজ এ অধ্যাদেশকে কালাকানুন হিসেবে অভিহিত করে। একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হতো সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ এখতিয়ার সংরক্ষণ করত প্রাদেশিক সরকার। শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতপ্রকাশ ও দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল নিষিদ্ধ। সরকার সমর্থকদের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল না। 

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্বের এ নিপীড়নমূলক চক্রান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র ও শিক্ষক সমাজকে অনেক বিক্ষোভ এবং আন্দোলনে শরিক হতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বাতিল করে জারি করে ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ। এ আদেশ জারির ফলে স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

 

এমন এক সময় ছিল যখন শুধু শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ও অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। অত্যাচার, জুলম, নির্যাতন, দুর্নীতি, শোষণ, নিষ্পেষণ, স্বৈরতন্ত্র উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং অকাতরে জীবন উৎসর্গ করার ইতিহাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা ও গৌরবের ইতিহাস।

 

প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাবি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একে গৌরব, মান-মর্যাদা ও সুনাম সমুন্নত রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা, রাহাজানি, খুনখারাপি হয়েছে, অসংখ্য লাশ পড়েছে, বহুবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, সেশনজটে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ দূষিত হওয়া ছাড়াও মানের অবনতি ঘটেছে।

 

এসবের মূলে ছিল স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেপরোয়া ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, অনেক শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মে চরম অবহেলা, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির পেছনে সরকার ও বিরোধী দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদদান এবং নগ্ন হস্তক্ষেপ। দলীয় অযোগ্য লোকদের প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়োগদান, প্রশাসনিক পর্যায়ে শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের নির্লজ্জ অপব্যবহার, দলীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগসহ সর্বস্তরে আরো বহু অনিয়ম ও দুর্নীতি। 

 

মেধা ও যোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের অনেক ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। এতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এগুলোতে রাজনীতির নামে স্বাধীনতার পর থেকে যা হয়ে আসছে, তা কোনো রকমেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্ন থেকে। 


বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানানো হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বরাবরই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে ছিল। যে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা দলের নিজেদের যোগ্যতার ওপর আস্থা নেই, নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির যৌক্তিকতায় নিজেরাই সন্দিহান, সহায়ক পেশিশক্তি ও স্তাবক ছাড়া চলার উপায় থাকে না বলে তাদের ছাত্ররাজনীতির ওপর এত বেশি নির্ভর করতে হয়। 

 

ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ কী, তা কেউ জানে না। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি থাকবে, না কোনো এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে, তা-ও রাজনৈতিক বিতর্ক। তবে অনেকেই মনে করে, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয়। ছাত্র-শিক্ষকরা স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে রাজনীতি করতে পারলে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু তারা যখন জাতীয় দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে ফেলেন, তখন তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। খারাপ লাগে আরো যখন দেখা যায়, এ অশুভ ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী জিম্মি হয়ে পড়েন।

 

জগন্নাথ হলের দক্ষিণ পাশের একটি দেয়াললিখন আমার প্রতিদিন চোখে পড়তো। দেয়ালে লেখা ছিল, ‘সে-ই প্রকৃত যুবক যার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার তেজ আছে।’ আমাদের ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকদের মধ্যে আমি এখন আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার তেজ, জেদ বা মানসিকতা দেখি না। আরো একটি দেয়াললিখন আমাকে মুগ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর এই অবিস্মরণীয় উক্তিটি টিএসসির পশ্চিম পাশের দেয়ালে লেখা ছিল, ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিদিন ওটা আমার চোখে পড়তো। উক্তিটি হলো, ‘তোমাদের কলম হোক শোষণমুক্তির হাতিয়ার।’ 


দুর্ভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখন আমাদের কলমকে আমরা ব্যবহার করছি চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, দুর্নীতি, শোষণ ও তোষামোদির হাতিয়ার হিসেবে। সেই যাক, ফিরে আসি বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক দলের অনুগত এবং এসব দলের মতাদর্শে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষকের জীবনের মূলমন্ত্রই হলো রাজনীতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। রাজনৈতিক আনুগত্য ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া সরকার কোনো সময়ই কোনো শিক্ষককে এসব আকর্ষণীয় পদে বসায় না। 

 

সুতরাং দেওয়া-নেওয়ার এ পলিসির সুবাদে সরকার-বিরোধী দলের সঙ্গে শিক্ষকদের এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে এ প্রচেষ্টায় সবাই সফলতা অর্জন করেন না। এরপরও তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পরিশ্রম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অধ্যবসায়ের কমতি নেই। এ লক্ষ্য সামনে রেখে অনেক শিক্ষক শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণা এবং অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রম উপেক্ষা করে রাজনীতির পেছনেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেন। তারা প্রতিটি ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, ভোটারদের অফিস-ল্যাব-ক্লাস সর্বত্র তাড়িয়ে বেড়ান এবং আধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোট ভিক্ষা করেন। 


অবস্থাটা এমন, আজকাল শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই অনেক শিক্ষক বুঝে ফেলেন যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞান-গরিমা, গবেষণা মুখ্য নয়। রাজনীতি-দলীয় আনুগত্যই জীবনে উন্নতি এবং অগ্রগতির মূল সোপান। তাই তারা তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির কথা ভুলে রাজনীতির পেছনে ছোটেন। অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত তারা থামেন না।

 

ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি যদি দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য হয়; অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন প্রতিরোধ, মুক্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার সংগ্রাম যদি হয় ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির মূলনীতি, তাতে কারো অমত বা অনীহা থাকার কথা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাধ্যমে দেশ ও দশের মঙ্গল করতে যে মূল্যবোধ, সহনশীলতা, যুক্তিসংগত আচরণ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতিবোধ, জ্ঞান-বুদ্ধির দরকার, যা আজকাল অনেক ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। 

 

পরিচ্ছন্ন রাজনীতির জন্য জাতীয় পর্যায়ে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের সুসম্পর্ক এবং সহনশীল সহাবস্থানের নিশ্চয়তা থাকাটাও জরুরি। দেশের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, প্রশাসনকে দেখতে চায় পূতপবিত্র, নিষ্কলঙ্ক-নির্দোষ, দায়িত্ব-কর্তব্যপরায়ণ, নিরপেক্ষ ও সৎ। কিন্তু বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা পুরোপুরি উপেক্ষিত। কারণ আমরা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করি; কিন্তু দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যাই। 


আমরা অন্যায় করি; অথচ শাস্তি ভোগ করি না। ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করি, তার পরও কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। মূল্যবোধ, নৈতিকতা, নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অধঃপতন ঘটেছে। জবাবদিহির অভাব আমাদের স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। আমাদের কিছু শিক্ষক ঠিকমতো ক্লাস নেন না, পরীক্ষা নেন না, পরীক্ষা নিলেও সময়মতো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন না। এক শ্রেণির শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে নিজের ক্লাস নেওয়ার সময় পান না। 


বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন ও নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সব সদস্যের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকে, তেমনি প্রশাসন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, সরকারের কাছে ও দেশবাসীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভালো না চলে পারে না। 


সত্যি কথা হলো, এ দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির অভাবে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যত ভালো চলার কথা তত ভালো চলছে না। চারদিক থেকে অনেক দুর্নাম কুড়াচ্ছে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এভাবে চলতে পারে না বা চলতে দেওয়াও যায় না। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পয়সায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তাই ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রশাসনের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে, দেশ ও দশের স্বার্থে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।


স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেপরোয়া ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, রাজনীতির পেছনে সরকারি-বিরোধী দলের মদদদান, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের পক্ষপাতমূলক আচরণ-দুর্নীতি, শিক্ষকদের কনসালট্যান্সি, এনজিওসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আর্থিক ফায়দা অন্বেষণ, ক্লাস ফাঁকি, কর্তব্যকর্মে অবহেলা, ফলত শিক্ষার মানের অনিবার্য অবনতি, সর্বত্র দলাদলি, ব্যক্তি, গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারের রাজনীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এর অপব্যবহারসহ আরো বহু অভিযোগ সর্বক্ষেত্রে অমূলক, অসত্য না হলেও এসবের জন্য একক ও একচ্ছত্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করাটা অন্যায় হবে। 


কারণ বিশ্ববিদ্যালয় আইসোলেটেড বা ইনসুলেটেড কোনো দ্বীপ নয়। দেশের ক্রমাবনতিশীল সার্বিক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গনে পড়বে না—এ ধরনের অবাস্তব ও অসংগত মনোভাব পোষণ করা সমীচীন নয়।  আমাদের সবার কিছু না কিছু দোষত্রুটি রয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, প্রশাসন, নেতা-নেত্রী, দেশবাসী—কেউই এ দোষত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষাঙ্গনে যেসব দোষত্রুটি আমাদের অপছন্দ, তা থেকে উত্তরণে আমাদের সবার নিজ নিজ দায়িত্ব এবং কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা দরকার। 


দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করাও আবশ্যক হয়ে পড়েছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং মানোন্নয়নের জন্য ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ওপর থেকে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার না করা হলে শিক্ষার মানে আরো অবনতি ঘটবে। 


দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্য বাদ দিয়ে আইন-কানুন, নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হলে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনিয়ম এবং দুর্নীতি মুক্ত করে সম্মানজনক অবস্থানে ফিরিয়ে আনা কোনো দুরূহ ব্যাপার নয়। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতা জীবনের অবসান হয়েছে। তবুও আমার এই প্রত্যাশা একদিন নিশ্চয় পূর্ণ হবে—এই আশা আমি সব সময় রাখি।


লেখক : মুনিরুদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি