ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৩৮

নারীর ঋতুবন্ধ বা মেনোপজ নিয়ে যত কথা

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৩:০৪ ৩ জানুয়ারি ২০২২  

গত তিনমাস ধরে রাহেলার (৪৭) বুক ধড়পড় করে। মাথায় যন্ত্রণা হয়। কয়েকদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেন শরীর ঘামে ভিজে গেছে। হঠাৎ গরম লাগে। কখনো হাত-পা-কান গরম হয়। বিষয়টি স্বামীকে জানালে তিনি বলেন, দুশ্চিন্তা থেকে এমন হচ্ছে।

 

একদিন রাহেলা সাহস করে নিজেই হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানতে পারেন, তার মেনোপজ হয়েছে। চিকিৎসক তাকে আশ্বস্ত করেন এগুলো কোনো রোগের উপসর্গ নয়। মেনোপজের কিছু লক্ষণ। যা ধীরে-ধীরে কমে যাবে এবং সহনীয় হবে। তবে সাবধান থাকতে হবে। কিছু নিয়ম মেনে চললে এবং নিয়মিত চেকআপ করলে ভালো থাকা যায়।

 

রাহেলা তাই করেছেন। তিনি বলেন, “এটা মেনে নিলেই সমস্যাগুলোকে, সমস্যা মনে হয় না। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। কিছু নিয়ম মেনে চলি। এখন আমি অনেক ভালো আছি।”

 

বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে কমপক্ষে ত্রিশ লাখ ঋতুবন্ধ নারী রয়েছেন। এর সাথে প্রতিবছর আশি হাজার নারী যোগ হন। এসব নারীর চিকিৎসায় প্রয়োজন সহমর্মিতা এবং এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা।

 

সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মালিহা রশিদ বলেন, “নারীদের জীবনে ঋতুবন্ধ বা মেনোপজ প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে। এটা নির্ধারিত। সাধারণত চল্লিশের পর থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নারীর নিয়মিত ঋতুচক্র থেমে যায়। অনেক সময় এর আগে বা পরে হয়। শরীর থেকে হরমোন (ইস্ট্রোাজেন ও প্রোজেস্টেরণ ও অন্য দু’ একটি হরমোন) নিঃসরণ এ সময় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় একেই বলে মেনোপজ।”

 

তিনি আরো বলেন, ওভারি (ডিম্বাশয়) থেকে হরমোন নিঃসরণ থেমে যাওয়া বা ঋতুনিবৃত্তি কোনো অসুখ নয়। তবে এর কিছু ক্ষণস্থায়ী প্রভাব রয়েছে।”

 

ক্ষণস্থায়ী প্রভাবগুলো যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয় সেজন্য সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত চেকআপ করতে হবে বলে চিকিৎসকরা জানান। মেনোপজের লক্ষণগুলো হলো- হঠাৎ প্রচন্ড গরম লাগা, রাতে ঘেমে যাওয়া এবং পর মূহুর্তে দুর্বল লাগা, খিটিমিটি মেজাজ, অস্থিরতা, কাজে মনোযোগ না পাওয়া, ঘন-ঘন প্র¯্রাব হওয়া, সঙ্গমে অনীহা, যোনিদ্বারে শুস্কতা, যৌনমিলনে ব্যাথ্যা ইত্যাদি। ডা. মালিহা বলেন, “অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেনোপজ সমস্যার কারণে অনেক সময় মধ্য বয়সে এসেও অনেক নারীর স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।”

 

তিনি জানান,“মেনোপজ হলে মানসিক চাপ বাড়ে। এসময় কাউন্সিলিং প্রয়োজন। আমাদের দেশে এর প্রচলন খুবই কম। অনেকে সমস্যা বলতে চান না। এ ধরণের সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি ব্যবস্থা রয়েছে যার নাম হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি)। এ থেরাপির মাধ্যমে শরীর থেকে যে হরমোন শুকিয়ে যায় তা বাইরে থেকে যোগানোর ব্যবস্থা করা হয়। উন্নত বিশ্বের নারীরা হরমোন থেরাপির মাধ্যমে নিজেদের সৌন্দর্য্য ও যৌবন ধরে রাখেন।”

 

শুধু সৌন্দর্য্য ও যৌবন ধরে রাখার জন্য নয়, সুস্থ্য থাকার জন্যও এইচআরটি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবধরণের নারীদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এ সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন জানান, “এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রচারণা প্রয়োজন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি মাধ্যমে জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন। নারীরা সচেতন হলেই বুঝতে পারবেন তাদের কী করা উচিৎ। আমাদের এখানে যারা সদস্য নন তারাও কাউন্সিলিং সুবিধা পেতে পারেন।”

 

শুধু মেনোপজ সোসাইটি নয়, খোঁজ নিয়ে জানা যায় অনেক হাসপাতালে এ বিষয়ে কমবেশি কাজ হয়। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল মেনোপজ আউটডোর ক্লিনিক নামে একটি হেলথ চেকআপ ব্যবস্থা চালু করেছে। তুলনামূলক কম খরচে এখানে মেনোপজের চিকিৎসা পাওয়া যায়। এখানকার চিকিৎসক ডা. ফরিদ আহমেদ বলেন, “মেনোপজ হলে নারীরা ভাবতে শুরু করেন তাদের জীবন শেষ। এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। নিয়মিত চেকআপ করে ব্যবস্থা নিলেই সমস্যা কেটে যায়। তবে সবচেয়ে প্রয়োজন স্বামী ও পরিবারের সহযোগিতা।”

 

সকলের সহযোগিতার আগে নিজেই নিজেকে সহযোগিতা করতে হবে। ভয় নয়, জানতে হবে-এমনটাই  মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল। তিনি জানান, “এক্ষেত্রে নারীর প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। এটাকে মেনে নিলে জটিলতা কমে যাবে। এ সময় জীবনকে নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা  করা প্রয়োজন। এ বয়সে নারী তার চারপাশ থেকে অনেক পরিজন হারাতে শুরু করেন। সন্তানরা বড় হয়ে যায়। নারী অনেকটা একা হয়ে পড়েন। শরীরের এই পরিবর্তন তাকে আরো অসহায় করে তোলে।”

 

এ জন্য চিকিৎসকরা বলছেন, সয়াবিন, শাকসবজি, ব্যায়াম, প্রফুল্ল মন, হরমোন থেরাপি এবং নিয়মিত চেকআপই মেনোপজ সমস্যায় নারীদের সহায়তা করতে পারে। তবে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা।