ঢাকা, ২৪ এপ্রিল বুধবার, ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৩২১

প্রবাসীদের কষ্টকর প্রবাসজীবন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:০১ ৪ আগস্ট ২০২২  

২০১৮ সালের ১৯ জুলাই হজ পালনের জন্য সস্ত্রীক মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করি। মক্কায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ক্লক টাওয়ারের পাশে রিতাজ হোটেলে। এই হোটেলে আমরা ১৮ দিন ছিলাম। ভালোই ছিলাম এই হোটেলে। কাবার একদম কাছাকাছি, যেতে আসতে ৫ মিনিটের বেশি সময় লাগতো না।

 

আমরা এক রুমে ওপরে নিচে ৬ জন থাকতাম। আমাদের মোয়াল্লেমর পক্ষ থেকে প্যাকেটে করে দুপুর ও রাতের খাবার সরবরাহ করা হতো। যে খাবার দেয়া হতো তা একজনের জন্য বলতে গেলে বেশিই ছিল। তাই প্রথম কয়েক বেলা আমাদের অনেকের খাবার অপচয় হতো। এটা ছিল আমার ও আমার স্ত্রীর জন্য একটি কষ্টকর ব্যাপার। খাবার অপচয় গুনাহর কাজ। আমরা উদ্বৃত্ত খাবার সদ্ব্যবহারের উপায় খুঁজছিলাম। আল্লাহ আমাদের সে ব্যবস্থা করে দিলেন।

 

আমরা হোটেলে উঠার পরদিন দেখলাম ৪ থেকে ৫ জন বাঙালি যুবক বারান্দায় ঘুরাঘুরি করছে। জিজ্ঞেস করলাম- আপনারা কি করেন এই হোটেলে। জানলাম- ওরা সবাই রুমবয়। একদিন ওদের রুমে ডেকে এনে গল্প জুড়ে দিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল ওদের প্রবাস জীবন সম্পর্কে একটা পরিপূর্ণ ধারণা নেয়া। বাড়ি-ঘর, জায়গাজমি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা ধার-কর্জ করে এরা বিদেশে এসে কত টাকা উপার্জন করে, কোথায় থাকে, কীভাবে জীবনযাপন করে, কতদিন অন্তর দেশে যেতে পারে, দেশে কীভাবে বা কত টাকা পাঠাতে পারে - এসব বিষয়ে পরিপূর্ণ একটি ধারণা এদের সাথে আলাপ করে এবং পরবর্তী সময়ে মদিনায় গিয়েও প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সাথে আলাপ করে আমি জেনে গেলাম।

 

আপনারা শুনে অবাক হবেন- ব্যাতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ প্রবাসীর জীবনে লুকিয়ে আছে এক একটি করুণ কাহিনী। এসব করুণ কাহিনী বর্ণনা করার নয়, অনুভব করার বিষয়। ওরা ওখানে ভালো নেই। অনেক কষ্টে আছে।
মদিনার হোটেলে কর্মরত এক প্রবাসীর করুণ হৃদয় বিদারক কষ্টের কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। আমরা যেদিন মক্কায় ফিরছিলাম- সে যুবক বলেছিলেন, স্যার আমাকে অল্প হলেও কিছু টাকা দিয়ে যাবেন। আমার অনেক উপকার হবে। বাড়ি যেতে পারি না বহু বছর টিকিটের টাকার অভাবে। দেশে স্ত্রী এক ছেলে ও মা আছেন।

 

আমি টাকা না পাঠালে তাঁদের উপোস করতে হয়। এই হোটেলে কাজ করে আমি যা উপার্জন করি তাতে আমার নিজের চলতেই কষ্ট হয়। টাকা বাঁচানোর জন্য আমি প্রায় উপোস করি বা কম খাই।  তার কষ্টের কাহিনী শুনে সেদিন আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল, কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। কী আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এরা বিদেশে আসে, আর এখানে এসে তারা কী মানবেতর জীবনযাপন করে। দেশে বসে ক'জন এসব ভাবে বা ভাবতে পারে!

 

অথচ এ মানুষগুলো যখন দেশে আসে তখন তাদের কতো অবজ্ঞা, কতো অবহেলা, কতো লাঞ্চনা-গঞ্জনা সইতে হয়। এদের যথাযোগ্য সম্মান জানানো হয় না। আমরা শুধু এদের কাছে রেমিট্যান্স চাই, এদের ন্যায্য প্রাপ্য সুযোগসুবিধা বা স্বাচ্ছন্দটুকু দেয়ার  কথাটা ভাবি না। আমরা কতো নির্লজ্জ স্বার্থপর জাতি।

 

ফিরে আসি মক্কার প্রবাসী যুবকদের কাহিনীতে। ওদের অবস্থাও মোটামুটি একই রকম। দুয়েকজনের অবস্থা ভীষণ করুণ। আমার স্ত্রী একদিন আমাকে বলল- আমাদের উদ্বৃত্ত খাবারগুলো ফেলে না দিয়ে আমরা এগুলো এই যুবকদের দিতে পারি না? ওদের ভাষ্য মতে ওরা সচ্ছল নয়, নগন্য পরিমাণ বেতন পায়, যা বেতন পায় প্রায় সবটাই দেশে পাঠাতে হয়। অতি কষ্টে ওদের দিন কাটে। কথাটা আমার পছন্দ  হলো। কিন্তু বলি কি করে! যদি এই প্রস্তাবকে ওরা খারাপভাবে নেয়? যদি আত্মসম্মানে লাগে! আমার বিশ্বাস ছিল হয়ত খারাপভাবে নেবে না।

 

প্রতিদিন ওরা রুমে আসতেন, কাজ করতেন এবং এতে করে ওদের সাথে আমাদের একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁরা আমাদের যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন, যখন তখন খোঁজ-খবর নিতেন, কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করতেন। একদিন এক যুবককে গোপনে প্রস্তাবটি দিলাম। ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। ও বলল- তাহলে তো স্যার ভালোই হয়।

 

এতগুলো খাবার পেলে আমাদের দুপুর ও রাতের খাবারের সংস্থান হয়ে যাবে। আমাদের অনেক টাকা বেঁচে যাবে। তারপর থেকে আমি প্রতিদিন সবার কাছ থেকে উদ্বৃত্ত খাবার জমিয়ে রাখতাম, ওদের একজন এসে কোনো এক সময় খাবারগুলো নিয়ে যেত। পুরো আঠার দিন আমরা ওদের এভাবে খাবার সরবরাহ করেছি। এটা যে আমাদের জন্য কীরকম স্বস্তি ও আনন্দের ব্যাপার ছিল তা হয়ত আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। বিদায় নেওয়ার দিন আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল।

 

ভাবছিলাম- আমার সামর্থ্য ও ক্ষমতা থাকলে এসব হতভাগ্য প্রবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য বড় কিছু একটা করতাম। ওই মূহুর্তে যা করতে পেরেছি তা হলো আমি ওদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে কোলাকুলি করছি, মন খুলে দোয়া করেছি, একটু চোখের পানি ফেলেছি, প্রত্যেকের হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দিয়েছি। দেখলাম - ওদের সবার মন খারাপ এবং চোখে পানি।

লেখক: অধ্যাপক ড. মুনিরুদ্দিন আহমেদ
সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।