ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ১১ পৌষ ১৪৩২
good-food

তারেকসহ নির্বাসন থেকে ফেরা বিশ্বের নেতাদের সাতকাহন

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৯:৩৬ ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫  

নেতাদের নির্বাসন প্রায় সময়ই তাদের রাজনীতির শেষ অধ্যায় মনে হয়। ক্ষমতা হারানো, দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া, নিজের মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া—সব মিলিয়ে যেন এক ধরনের রাজনৈতিক শাস্তির শামিল নির্বাসন। কিন্তু ইতিহাস বলে, নির্বাসন প্রায় কখনোই শেষ কথা নয়। বহু নেতার জন্য এটি ছিল সাময়িক বিরতি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর দেশে ফিরে এসে কেউ হয়েছেন নায়ক, কেউ আবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। তাদের প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতির গতিপথ বদলে দেওয়ার মুহূর্ত।

নির্বাসন একজন নেতাকে সরিয়ে দেয় দেশের রাজপথ, জনসমাবেশ আর রাজনৈতিক কেন্দ্র থেকে। কিন্তু একই সঙ্গে এই দূরত্ব অনেক সময় তাকে আরও শক্ত প্রতীকে পরিণত করে। সমর্থকদের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যায়ের শিকার, অসমাপ্ত লড়াইয়ের মুখ। ফলে তার ফিরে আসা মানেই পুরোনো স্মৃতি, আশা আর ভয়—সবকিছুর একসঙ্গে ফিরে আসা।

বিশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত প্রত্যাবর্তনের একটি হলো ইরানের আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির দেশে ফেরা। ইরানের শাহ সরকারের বিরোধিতা করায় তাকে নির্বাসনে যেতে হয়। তিনি তুরস্ক, ইরাক ঘুরে শেষ পর্যন্ত ছিলেন ফ্রান্সে। নির্বাসনে থেকেও তার বক্তব্য ইরানে পৌঁছাত ক্যাসেটের মাধ্যমে। মসজিদ আর ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ত সেই কথা। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন তিনি তেহরানে ফেরেন, তখন লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শাহ ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন, পুরোনো শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। খোমেনির প্রত্যাবর্তন ছিল শুধু একজন নেতার ফেরা নয়, বরং একটি বিপ্লবের প্রকাশ্য সূচনা। অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানের রাজনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি বদলে যায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় এমন আরেকটি আবেগঘন প্রত্যাবর্তনের নাম বেনজির ভুট্টো। পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানে তার বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত ও পরে ফাঁসি দেওয়ার পর বেনজিরকে নির্বাসনে যেতে হয়। ১৯৮৫ সালে তিনি দেশে ফেরেন। লাহোরে তার আগমন ঘিরে বিপুল জনসমাগম হয়, যদিও চারপাশে ছিল কড়া নজরদারি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। নির্বাসনের বছরগুলোতে বেনজির হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ। দেশে ফিরে তিনি আবার যুক্ত হন তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে। তার রাজনৈতিক জীবন ছিল উত্থান-পতনে ভরা এবং শেষটা ছিল বেদনাদায়ক। তবে সেই প্রথম প্রত্যাবর্তন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল।

আফ্রিকার রাজনীতিতেও নির্বাসন থেকে ফেরার গল্প কম নয়। নেলসন ম্যান্ডেলার কথা সাধারণত কারাবাসের প্রেক্ষাপটে বলা হয়, তবে আফ্রিকার অনেক নেতাই বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন। ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট কোয়ামে এনক্রুমা ক্ষমতাচ্যুত হন দেশের বাইরে থাকা অবস্থায়। তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। আবার ইথিওপিয়ায় ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ দীর্ঘদিনের নির্বাসিত বিরোধী নেতাদের দেশে ফেরার আহ্বান জানান। এতে রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়, যদিও একই সঙ্গে দেখা দেয় নতুন টানাপোড়েন।

লাতিন আমেরিকায় নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তনের গল্প আরও নাটকীয়। আর্জেন্টিনার নেতা হুয়ান পেরোন ১৯৫৫ সালে ক্ষমতা হারিয়ে নির্বাসনে যান। প্রায় ১৮ বছর তিনি দেশের বাইরে থাকেন, কিন্তু দেশজ রাজনীতিতে তার প্রভাব কমেনি। স্পেনে বসেও তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার রাজনীতির বড় এক ছায়া। ১৯৭৩ সালে দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে স্পষ্ট হয়, দেশ কতটা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তবু পেরোনের ফেরা দেখিয়ে দেয়, নির্বাসন রাজনৈতিক শক্তিকে মুছে দেয় না; অনেক সময় সেটিকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে। 

ইউরোপেও স্বৈরশাসনের পতনের পর নির্বাসিত বা কোণঠাসা নেতাদের ফিরে আসার নজির রয়েছে। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের পর অনেক বিরোধী নেতা দেশে ফিরে নতুন রাষ্ট্রগঠনে ভূমিকা রাখেন। চেকোস্লোভাকিয়ার ভ্যাক্লাভ হাভেল দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক ছিলেন। পরে তিনিই হন দেশের প্রেসিডেন্ট। তার উত্থান দমন-পীড়নের পর নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে।

বর্তমান সময়ে নির্বাসনের চেহারা বদলেছে। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার কারণে নির্বাসিত নেতারা আর পুরোপুরি অনুপস্থিত নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ভিডিও বার্তা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তারা নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। ফলে তাদের দেশে ফেরা আগেভাগেই আলোচনায় আসে। অনেক সময় তা হয়ে ওঠে পরিকল্পিত রাজনৈতিক ঘটনা।

নির্বাসন শেষে নেতাদের দেশে ফেরা সমর্থকদের জন্য আশার বার্তা, প্রতিপক্ষের জন্য শঙ্কার কারণ। আর রাষ্ট্রের জন্য এটি এক বড় পরীক্ষা—রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা স্থিতিশীল, কতটা সহনশীল- এর মাপকাঠিও। 

এই কারণেই নির্বাসন শেষে নেতাদের ফেরার গল্প বারবার মানুষের আগ্রহ জাগায়। এখানে শুধু ক্ষমতা বা রাজনীতির হিসাব নয়, আছে মানুষের ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা, স্মৃতি আর নিজের জায়গায় ফেরার গভীর অনুভূতি। রাজনীতির ইতিহাস তাই কখনো সরল রেখায় চলে না। পুরোনো প্রশ্ন, পুরোনো নাম আবার ফিরে আসে—নতুন সময়ের মুখোমুখি হয়ে।