ঢাকা, ২১ নভেম্বর শুক্রবার, ২০২৫ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২
good-food

ভূমিকম্পের কোন মাত্রায় ঝুঁকি কতটা

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৬:৫৬ ২১ নভেম্বর ২০২৫  

ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক ঘটনা, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই একটি শহর বা অঞ্চলের চিত্র পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। এই অল্প সময়ের কম্পনই কেড়ে নিতে পারে অগণিত প্রাণ এবং ধ্বংস করে দিতে পারে বহু বছরের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা অবকাঠামো। ভূমিকম্পের পর আমরা খবরে প্রায়ই শুনি, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৬ বা ৬.২। কিন্তু এই সংখ্যা বা মাত্রা আসলে কী কীভাবে এটি নির্ধারিত হয় এবং কোন মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আসুন, এই বিষয়গুলো সহজভাবে জেনে নিই।

 

ভূমিকম্পের মাত্রা কীভাবে পরিমাপ করা হয়

সহজ ভাষায়, ভূমিকম্পের মাত্রা হলো এর উৎসস্থলে (কেন্দ্রে) নির্গত হওয়া মোট শক্তির একটি পরিমাপ। পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে যখন শক্তি জমা হতে থাকে, তখন তা একসময় হঠাৎ মুক্ত হয়। এই শক্তি ভূকম্পন তরঙ্গ হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি করে।

এই কম্পনের শক্তি পরিমাপের জন্য বিজ্ঞানীরা সিসমোমিটার নামক একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেন। এই যন্ত্রটি মাটির কম্পনের গতি, শক্তি এবং স্থায়িত্বকাল নিখুঁতভাবে রেকর্ড করে। সিসমোমিটারে রেকর্ড হওয়া ডেটা একটি গ্রাফ বা রেখাচিত্র তৈরি করে, যাকে সিসমোগ্রাফ বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে থাকা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো থেকে পাওয়া সিসমোগ্রাফ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের শক্তি বা মাত্রা নির্ধারণ করেন।

রিখটার স্কেল থেকে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল

ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপের জন্য দুটি স্কেল সবচেয়ে পরিচিত-

রিখটার স্কেল: ১৯৩৫ সালে মার্কিন ভূকম্পবিদ চার্লস এফ. রিখটার এবং তাঁর সহকর্মী বেনো গুটেনবার্গ এই স্কেলটি উদ্ভাবন করেন। এটি একটি লগারিদমিক স্কেল, যার অর্থ হলো—স্কেলে মাত্রা এক বাড়লে ভূমিকম্পের কম্পনের ক্ষমতা দশ গুণ বেড়ে যায়। তবে নির্গত শক্তির হিসাবে, প্রতি এক মাত্রা বৃদ্ধিতে শক্তি প্রায় ৩২ গুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ, ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ৫ মাত্রার চেয়ে ৩২ গুণ বেশি শক্তিশালী। রিখটার স্কেল মাঝারি এবং কাছাকাছি দূরত্বের ভূমিকম্পের জন্য বেশ কার্যকর হলেও খুব শক্তিশালী বা দূরের ভূমিকম্পের শক্তি নির্ভুলভাবে মাপতে পারে না।

মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল: বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই স্কেলটিকেই আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি রিখটার স্কেলের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল, কারণ এটি কেবল কম্পনের তীব্রতা নয়, বরং ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলে শিলাচ্যুতি বা ফাটলের পরিমাণ এবং সেখান থেকে মোট কত শক্তি মুক্ত হয়েছে তা হিসাব করে। তাই বড় এবং বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সঠিক শক্তি নির্ণয়ের জন্য এই স্কেলটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।

এছাড়া, ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপের জন্য মডিফাইড মার্কালি ইনটেনসিটি স্কেল ব্যবহার করা হয়। এটি কোনো স্থানে ভূমিকম্পের ফলে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি, মানুষ কী ধরনের কম্পন অনুভব করেছে এবং বস্তুগত প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে তীব্রতা নির্ধারণ করে।

 

ভূমিকম্পের মাত্রা কারা ঘোষণা করে

ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ ও তা বিশ্ববাসীকে জানানোর কাজটি করে বিভিন্ন দেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) এটি বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প নিরীক্ষণ এবং তথ্য সরবরাহকারী অন্যতম প্রধান সংস্থা। যেকোনো বড় ভূমিকম্পের পর এর মাত্রা, উৎস এবং অন্যান্য তথ্য দ্রুত তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ISC) এটি একটি বেসরকারী এবং অলাভজনক সংস্থা, যা বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্পের তথ্য সংগ্রহ করে এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। একে বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের তথ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

 

 

জাতীয় সংস্থা প্রতিটি দেশের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকে। বাংলাদেশে এই কাজটি করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর-এর সিসমোলজি ইউনিট। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা সিসমিক স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভূমিকম্পের মাত্রা ও উৎসস্থল সম্পর্কে জানায়।

এই সংস্থাগুলো তাদের বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিসমোগ্রাফ স্টেশনে রেকর্ড হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, সময়কাল, স্থায়ীত্ব এবং মাত্রা গাণিতিকভাবে নির্ধারণ করে। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া মাত্রার মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকে (যেমন, এক সংস্থা ৫.৭ বললে অন্য সংস্থা ৫.৫ বলতে পারে), কারণ তাদের পরিমাপের পদ্ধতি, ব্যবহৃত স্কেল ও তথ্য সংগ্রহের স্টেশনের মধ্যে দূরত্ব ভিন্ন হতে পারে।

কোন মাত্রার ভূমিকম্প কতটা ঝুঁকিপূর্ণ

ম্যাগনিটিউডের মান দেখে ঝুঁকি অনুমান করা যায়। কিন্তু বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে ভূমিকম্পের গভীরতা, কেন্দ্রস্থলের দূরত্ব, ভবনের মান, মাটির ধরন এবং এলাকাটি কতটা ঘনবসতিপূর্ণ তার ওপর। তবুও সাধারণভাবে ঝুঁকির ধারণা এমন

৩.০-এর কম মাত্রা খুব দুর্বল        

সাধারণত মানুষ অনুভব করতে পারে না, শুধু যন্ত্রে ধরা পড়ে। কোনো ঝুঁকি নেই।

৩.০ থেকে ৩.৯  মাত্রা মৃদু কম্পন

অনেকেই অনুভব করতে পারেন, তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় না।

৪.০ থেকে ৪.৯ মাত্রা হালকা কম্পন

ঘরের জিনিসপত্র বা জানালা কেঁপে উঠতে পারে। দুর্বল বা পুরনো ভবনে সামান্য ফাটল দেখা দিতে পারে। ঝুঁকি কম।

৫.০ থেকে ৫.৯ মাত্রা মাঝারি কম্পন

এটি মাঝারি শক্তির ভূমিকম্প। শক্তিশালী ঝাঁকুনি অনুভূত হতে পারে। দুর্বল ভবনের দেয়াল ধসে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ব্যস্ত এলাকায় ক্ষতি বাড়তে পারে।

৬.০ থেকে ৬.৯ মাত্রা শক্তিশালী কম্পন

এই মাত্রার ভূমিকম্প শক্তিশালী ধাক্কা দেয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কিছু ভবন ধসে পড়তে পারে।  বড় শহরে হলে ঝুঁকি অনেক বেশি।

৭.০ থেকে ৭.৯ মাত্রা খুব শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক

ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মজবুত ভবনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহানির শঙ্কা খুব বেশি।

৮.০ বা তার বেশি মাত্রা মহাধ্বংসাত্মক

এটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। শত শত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে এবং সুনামি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। ইতিহাসের ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলো সাধারণত এ মাত্রায় হয়েছে।

কেন এসব জানা জরুরি

বাংলাদেশ ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থান করছে। দেশে বড় ভূমিকম্প কম হলেও সম্ভাবনা আছে, আর তার প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। তাই ভূমিকম্পের মাত্রা, ঝুঁকি এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা সবার থাকা উচিত।

ভূমিকম্পের মাত্রা বোঝা মানে আতঙ্কিত হওয়া নয়; বরং সচেতন হওয়া। নিরাপদ ভবন নির্মাণ, জরুরি প্রস্তুতি এবং নিয়মিত মহড়া—এগুলোই ভবিষ্যতের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। সচেতন নাগরিকই পারে বড় বিপর্যয়কে ছোট করে আনতে।