ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৩০২৩

আবিরের আবেগঘন স্ট্যাটাস: বাবার মৃত্যু দুঃস্বপ্নের মতো

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১০:২৪ ১ মে ২০২০  

 করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকনের ছেলে আশরাফুল আবির বাবার এভাবে চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। বাবাকে নিয়ে ফেসবুকে আবেগতাড়িত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। 

আবির নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র। ওই ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, 'আমি ও আমার পরিবারের কাছে মনে হচ্ছে যে, আমরা হয়ত কোনো বাজে স্বপ্ন দেখলাম। কিন্তু এইটা যে আসলেই বাস্তবেই হয়ে গেল, আমরা এখনও বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমার কাছে এখনো মনে হচ্ছে, যেন একটা বাজে স্বপ্ন দেখে হয়ত ঘুমটা ভাঙল।'

দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক ছিলেন হুমায়ুন কবির খোকন। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে মঙ্গলবার রাতে তাকে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। পরে তার নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসে। বুধবার দুপুরে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে নিবেদিতপ্রাণ এই সাংবাদিককে দাফন করা হয়। সাংবাদিক খোকন স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। 

সাংবাদিক খোকনের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে ঢাকার মহাখালীর বাসায় আইসোলেশনে আছেন। বাবার অসুস্থতা ও মৃত্যুর পুরো ঘটনা এবং তাদের পরিবারের অবস্থা তুলে ধরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আশরাফুল আবির। পোস্টে তিনি আরও লেখেন, 'আমার বাবা একজন অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী ব্যক্তি ছিলেন, যিনি সারাটি জীবনে হয়ত নিজের কথা কখনো ভাবেননি। আমাদের জন্যই হয়ত সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেলেন। এই করোনা সংকটময় দিনেও তিনি ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটা দিন অফিসে গিয়েছেন, বাসায় এসেছেন। আমি এই নিয়ে আমার বন্ধুদেরও বলে ছিলাম যে, আমরা খুব ভয়ে আছি। কারণ আমার আব্বু আর আপু দু'জন চাকুরীজীবী পরিবারে এবং তারা প্রতিদিনই অফিসের গাড়ি দিয়েই অফিসে আসা যাওয়া করেছেন।'

আবির লেখেন, 'আমার বাবার ৩-৪ দিন ধরে কাশি হচ্ছিল, পরিমানটা দিন দিন বেড়েই চলছিল। আমার তখনই সন্দেহ হচ্ছিল। আমি বাবাকে বললাম, আপনার করোনা হয়নি তো? সে হেসে বলল, আরে ধুর বেটা টন্সিলের ব্যাথা, এইটা আগের থেকেই ছিল। ওই রকম কিছু না। সে চাচ্ছিল বাসায় থেকেই ট্রিটমেন্ট নিয়ে সুস্থ হতে। কারণ করোনাভাইরাস পজিটিভ হলে এলাকার ভেতর আতঙ্ক ছড়াবে। এছাড়া লজ্জায়, ভয়ে সে তখনও এইটা সাধারণভাবেই দেখছিল। আমিও ভাবলাম যে, হয়ত এই রকম জ্বর-কাশি সাধারণ, হয়ত বাসায় ওষুধ খেলে, গরম পানি খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি এই কয়দিন বাসায় সাধারণভাবেই কাটাচ্ছিলাম, বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপ করার জন্য অনেক কিছু শিখছিলাম। কিন্তু বাবার কাশি বেড়েই চলছিল। আম্মুও জ্বর অনুভব করতে শুরু করল তার দুই দিন আগে। তখন আমি ভয় পেয়ে গেলাম।'

স্ট্যাটাসে তিনি আরও লেখেন, 'আম্মুকে এটা বললে বলল যে নমুনা দুয়েকদিনের ভেতরই নিতে আসবে। কিন্তু বাবার কাশি বেড়েই চলছিল, কাশির সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল বলে মনে হয়। হয়ত বাবার গলা চুলকাচ্ছিল। আমি এরপরের দিন একটু দেরিতে উঠলাম, দেখলাম আম্মু বাবাকে জাউভাত রান্না করে খাওয়াচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম, সে জানি কেমন করছে। মনে হচ্ছে অনেক কষ্ট হচ্ছে, মনে হলো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সে ওই মুহূর্তে এই লড়াইয়ের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। আম্মু বলল সকালে অ্যাম্বুলেন্স খবর দেওয়া হইছে। উত্তরার রিজেন্টে ব্যবস্থা করা হইছে। অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে। আমি ঘরে পরার জামা পরেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠে গেলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিল এমনিতেই দেরি হয় গেছে।'

আক্ষেপ করে আবির লেখেন, 'ভাবলাম, হাসপাতালে হয়ত অনেকেই থাকবে আব্বুর জন্য, অফিসের লোক। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম, আমি আর আম্মু ছাড়া পরিচিত কেউ নেই। কারণ লকডাউন থাকার জন্য গাড়ি তেমন চলে না রাস্তায়, এছাড়া লক্ষণগুলোর বর্ণনা শুনে কেউ হয়ত আসতে সাহস করছিল না। সাবান আঙ্কেল (শাবান মাহমুদ) সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল ওইখানে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টাই করেছিল আইসিউই'তে রেখে অক্সিজেন দেওয়ার। কিন্তু ডাক্তার বলল, তার পালস নেই এবং ব্রেনও অক্সিজেন নিচ্ছে না। ডাইরেক্টলি বললেনও না যে, সে আগেই মারা গেছে। বলল, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি দোয়া করেন। রাত ১০টার দিকে আম্মুকে উপরে ডাকল শেষবারের মতো দেখার জন্য। তখন আম্মু ফোনে কয়েকজনকে জানিয়ে দেয়।'

বাবা হুমায়ুন কবির খোকনের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়ে তিনি লেখেন, 'সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন, যেন আল্লাহ ওনাকে জান্নাতবাসী করেন। ওনার মতো ভালো, সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ খুব কমই আছে সমাজে। আমরা সবাই সতর্কতা অবলম্বন করে বাসায় আছি। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করুক।'

সরকার ও বাবার অফিসের সহযোগিতা চেয়ে সবশেষে আবির লেখেন, 'আমাদের বন্ধু-স্বজনরা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েছে আমাদের সামনের দিনগুলো নিয়ে। আশা করি, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও বাংলাদেশ সরকার আমাদের পরিবারের পাশে থাকবে। বাস্তবতা কঠিন হয়ে গেছে। তবুও বাস্তবতার সাথেই সবকিছু এখন অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে।'

মিডিয়া বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর