ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৫৪৮

এ কেমন সাংবাদিকতা!

কেন সাইবার বুলিংয়ের শিকার বাংলাদেশি মডেল?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:৩৬ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  

করোনা মহামারি কাটিয়ে উঠে আবারো শোবিজ অঙ্গন মুখরিত হতে চলেছে। দেশ-বিদেশে কয়েকটি ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে মিডিয়া।

০১.

নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে ফ্যাশন দুনিয়ার অন্যতম বড় আসর ফ্যাশন উইক। প্রতিবছর দুবার- ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। করোনার কারণে ধারণা করা হয়েছিল, এবার সেটি হবে না। কিন্তু সব ধারণা অমূলক করে অবশেষে সীমিত আকারে হলেও তা হচ্ছে। 

 

গত কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে গত তিন বছর এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা হয়েছে বেশি। মডেল ও অভিনয়শিল্পী মোনালিসা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী ও মডেল তমা মির্জা, এসময়ের সুপরিচিত মডেল ও অভিনয়শিল্পী পিয়া জান্নাতুল এবং প্রবাসী মডেল ফারহান চৌধুরী বিভিন্ন সময় এর র‌্যাম্পে হেঁটেছেন। আরও কেউ এতে অংশ নিয়ে থাকতে পারেন তবে তা আমার জানা নেই।

 

এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সাউন্ডপেস’র কর্নধার ওমর চৌধুরীর ব্যবস্থাপনায় নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে অংশ নেন ডিজাইনার পিয়াল হোসেন। গত বছর এতে সরাসরি যুক্ত হয়ে অনেক কিছু দেখার, জানার, শেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেসময় বন্ধু রবিন খান আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। নিউইয়র্কের মূলধারার মিডিয়া থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের এনআরবি কানেক্ট টিভিসহ বাংলাদেশের মিডিয়ায় তা ব্যাপকভাবে কাভারেজ পেয়েছে। আয়োজকরােএ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। এতে দেশীয় মডেলদের পাশাপাশি বিদেশি মডেলরাও উপস্থিত ছিলেন।

 

এবারের ফ্যাশন উইক ছয়দিন ব্যাপী। ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে, চলবে ১৬ তারিখ পর্যন্ত। করোনার কারণে এবার বাংলাদেশ অংশ নিতে পারছে না। আশা করছি, সীমিত আকারে হলেও অনুষ্ঠানটি সফল হবে এবং আগামী বছর ফ্রেব্রুয়ারিতে জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিতব্য ফ্যাশন উইকে র‌্যাম্পে আবারও হাঁটবেন বাংলাদেশি মডেলরা।

 

০২.

নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইক নিয়ে যখন কথা বলছি, তখন বাংলাদেশের এক উঠতি মডেল সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। ঘটনার শুরু দেশের সেলিব্রেটি ফটোগ্রাফারের ফটোশুটে। সোমবার ওই ফটোগ্রাফার একটি ফটোশুটের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ছবিশুটের মডেল মেয়েটি কোমরে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড লুই ভিটনের (লুই ভিঁটো) বেল্ট পরে আছেন। বিপত্তিটা হলো, মেয়েটি বেল্টটা ঠিকমতো না পরার কারণে লুই ভিটনের সাইনটা উল্টে গেছে। এ নিয়েই শুরু হয়ে গেল সাইবার বুলিং। এতে সাধারণের পাশাপাশি মিডিয়ার মানুষেরাও অংশ নিলেন।

 

ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এটি ফটোশুট। কারণ শুটিংয়ের আনুষঙ্গিক সব প্রস্তুতি, মডেল ও ফটোগ্রাফারের অবয়ব একফ্রেমে ধরা পড়েছে। আমরা অনেকেই জানি, একটি ফটোশুটে শুধু মডেল ও ফটোগ্রাফারই থাকেন না। থাকেন আরও অনেকে। ছবিটিতেও তা দেখা যাচ্ছে। ছবিতে নেই এমন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও ফটোশুটে সম্পৃক্ত থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মডেলের স্টাইলার। 

 

অর্থাৎ যিনি মডেলের স্টাইল করে দেন তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি না, এ মডেলের স্টাইল কে করে দিয়েছেন। তবে এটা জানি, এ ছবিশুটের ক্যামেরা যার হাতে তিনি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা পরিচিত।িউনি মামুলি একজন ফটোগ্রাফার নন, ফটোগ্রাফির শিক্ষক এবং সেলিব্রেটিও বটে।

 

তাহলে লুই ভিটনের মনোগ্রামটি উল্টোভাবে পরার কারণে শুধু মেয়েটিকেই (যে কিনা উঠতি) কেন সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে? কেন স্টাইলার ও ফটোগ্রাফার নন? এখানে এ ফটোশুটের আয়োজক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা-ব্যক্তিরাও থাকতে পারেন। কারণ, মডেল ছবিতে যেভাবে মোবাইল ফোন হাতে ধরে রেখেছেন, তাতে এটা প্রতীয়মান হয়, এটি কোনো মোবাইল কোম্পানি বা ফোন অপারেটর কোম্পানির প্রচারের জন্য তা হতে পারে। তাছাড়া ফটোগ্রাফার নিজেও পোস্টে এটিকে কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফি ও ফটোশুট বলে উল্লেখ করেছেন।

 

বেল্ট উল্টো করে পরার দায় অনেকের। এটি অজ্ঞতার কারণে হতে পারে, হতে পারে অতিমাত্রায় অসচেতনতার কারণে। কিন্তু এজন্য সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন মাত্র নারী।

 

বুলিং বিষয়টাই খারাপ। এটা আরও জঘন্য হয়ে ওঠে তখন, যখন বড় মাছগুলোকে (রাঘব-বোয়াল) রেখে আপনি একটি ছোট মাছকে টার্গেট করেন। রুচি, বিবেচনাবোধ ও সাহসিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এটি যারা করেন, তাদের উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন হয়তো-সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/ মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়/ দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো/ নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো...।

 

০৩.

এবার বাংলাদেশের শোবিজে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আরেক বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা যাক। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গত বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাজধানী ঢাকার নিকেতনের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। ওই সময় শোবিজের অনেক পরিচিত ব্যক্তিরা তার বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলেন।

 

সোহাগ মানবপাচারকারী কি-না তা আরও ব্যাপকভাবে খতিয়ে দেখবে পুলিশ। দোষী প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি দেবে আদালত। যদিও পুলিশ প্রমাণ হাতে নিয়েই তাকে গ্রেফতার করেছে বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তবে তার গ্রেফতার হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও অনেকের নাম জড়িয়ে লেখালেখি হচ্ছে। তারা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের শোবিজের নামকরা মানুষ। কোনো প্রমাণ ছাড়া শুধু সোহাগের সঙ্গে ছবি আছে বলে কাউকে এ ঘটনায় জড়িয়ে ফেলা অন্যায়-অনুচিত কাজ হবে।

 

সোহাগ বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সেটি আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করে থাকেন দেশের সরকার প্রধান। তার সঙ্গে সবার ছবি থাকাই স্বাভাবিক। এটা দোষের কিছু নয়। এমন ঘটনা আমরা ‘প্রতারক’ রিজেন্ট হাসপাতালের শাহেদ করিমের ক্ষেত্রেও দেখেছি। তার সঙ্গে ছবি থাকার কারণে অনেক বিশিষ্টজনেরাই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। সোহাগ গ্রেফতার হওয়ার পর এখন যেমন দেশের সেলিব্রেটি অভিনয়শিল্পীরা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। শুধু ছবি থাকা, তার কাছ থেকে নাচ শেখা কিংবা বিদেশে অনুষ্ঠান করার কারণে কেউ দোষী হতে পারেন না।

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিনকে দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এতে করে যে কেউ যে কাউকে অপদস্ত করার সুযোগ পাচ্ছেন। কেউ কিছু একটা লিখে দিলেই তা ৫০ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করছেন কোনো কিছু যাচাই না করেই।

 

০৪.

সম্প্রতি প্রবাসী একটি টিভি চ্যানেলে নজিরবিহীন সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। কোনো টিভি চ্যানেল এর আগে নিজ গোত্রের কারও নামে এ ধরনের সংবাদ প্রচার করেছে কি-না আমার জানা নেই। সংবাদটিতে দেশের সেলিব্রেব্রিটি একজন সিনিয়র সাংবাদিককে জড়িয়ে দুর্নীতি, তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন সেখানে থাকা অবস্থায় নানা অপকর্ম এবং অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ আনা হয়েছে। আর কাজটি করতে গিয়ে এমন আরও অসংখ্য নারীর নাম জড়ানো হয়েছে; যারা সবাই পরিচিত সাংবাদিক-গণমাধ্যম কর্মী। 

 

রিপোর্টিংয়ে সিনিয়র সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সঙ্গে উল্লেখিত নারী সাংবাদিকদের কোনো বিষয়ে সহযোগিতা করা কিংবা সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ নেই। বরং ওই নারীরা সিনিয়র সাংবাদিকের দ্বারা ভিকটিম বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়ছে। তাহলে নারী সাংবাদিকরা চ্যানেলটির দ্বারা আরও একবার ভিকটিম হলেন কেন? ওইসব নারীর বেশিরভাগের সঙ্গেই যৌনতা শব্দটি যোগ করে দেয়া হয়েছে। একবারও ভাবা হয়নি ওই কর্মীরা আমাদেরই সহকর্মী এবং আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই নারী রয়েছে।

 

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, মিডিয়া কর্মীদের নিয়ে এ প্রপাগান্ডায় যারা আনন্দিত হচ্ছেন, তারা সবাই গণমাধ্যমেরই কর্মী। আমরা কি ভেবে দেখেছি, যেকোনো ঘটনা প্রচারিত হলে তা যত অবাস্তবই হোক পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ তা বিশ্বাস করেন। আর মানুষের মনস্তাত্বিক এ অবস্থানটিকে কাজে লাগিয়ে একদিন কেউ আপনাকেও ভিকটিম বানিয়ে ফেলতে পারে!! 

 

পরিশিষ্ট:
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ঘটনাবলীতে অনেক মানুষের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া হলেও আমার লেখায় শুধু ইভান শাহরিয়ার সোহাগ ও শাহেদ করিমের নাম নেয়া হয়েছে। কেননা, পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাদের দুজনকে গ্রেফতার করেছে।
হাসানুজ্জামান সাকী
নিউইয়র্ক

মিডিয়া বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর