ঢাকা, ২৯ মার্চ শুক্রবার, ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০
good-food
২২৫৩

কৌটার দুধ নয়, শিশুর পুষ্টিতে চাই বুকের দুধ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:২২ ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যত। সুতরাং সুন্দর আগামীর জন্য প্রতিটি শিশুকে গড়ে তুলতে হবে স্বযত্নে। জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিটি শিশুকে দিতে হবে সুষম খাদ্য। তবে বিশেষ করে জন্মের পর পরই প্রতিটি শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মায়ের বুকের দুধ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ সমাজের নারীরাও ব্যস্ত। অনেককেই অফিস কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। যে কারণে অনেক মা-ই সন্তানকে ঠিকমতো বুকের দুধ দিতে পারেন না, নির্ভর করতে হয় বাজারে পাওয়া বিভিন্ন কৌটা কিংবা প্যাকেট দুধের ওপর। 
তাদেরই একজন নাইমা খাতুন। একটি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা তিনি। দিনের বেশিরভাগ সময় অফিসে থাকেন তাই ‘পুষ্টি নিশ্চিত’ করতে পাঁচ মাসের ছেলেকে গুঁড়ো দুধ খাওয়ান নাজমা। বাচ্চাকে যে ব্র্যান্ডের দুধ খাওয়ান, সেটির নাম নেসলে ল্যাক্টোজেন-১। এর প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে ‘জন্ম থেকে দেয়া যায়’! প্লাস্টিকের যে ফিডারে করে নাইমার বাচ্চা দুধ খায়- সেটির গায়ে বড় করে লেখা ‘ফর অ্যাঞ্জেল’ (দেবশিশুর জন্য)! এমন চটকদার বিজ্ঞাপন এবং ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে নাজমার মতো অনেক অভিভাবকই আদরের সন্তানদের মুখে তুলে দিচ্ছেন বিকল্প শিশুখাদ্য। বাড়ছে গুঁড়ো দুধ খাওয়া শিশুর সংখ্যা। অথচ এই শিশুরা ভুগছে অপুষ্টিতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমছে তাদের। আর অভিভাবকদের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে এ সংক্রান্ত আইনকেও ‘বুড়ো আঙুল’ দেখাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। 
মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে শিশুদের জন্য কৌটা বা প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধ, অন্যান্য খাদ্য ও সরঞ্জামাদির প্রলুব্ধকর বিজ্ঞাপন বা প্রচারের ক্ষেত্রে আইনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । ২০১৩ সালের এ সংক্রান্ত আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, প্যাকেট ও কৌটাজাত পণ্যের গায়ে লেখা থাকতে হবে ‘শিশুর জন্য মায়ের দুধের সমতুল্য বা শ্রেষ্ঠতর কোনও খাদ্য নেই।’ আরও লেখা থাকতে হবে ‘এই (কৌটা/প্যাকেট) খাদ্য সম্পূর্ণ রোগজীবাণুমুক্ত নয়। এটা খেলে শিশুর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি আছে।’ বিকল্প শিশুখাদ্য বিপণন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে নির্দেশনা। 
তবে রাজধানীর বিভিন্ন সাধারণ দোকান ও সুপার শপে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বিকল্প শিশু খাদ্য ও সরঞ্জামের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতারা এসব নির্দেশনা মানছেন না। এ বিষয়ক আইন সম্পর্কেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের কেউ তেমন কিছু জানেন না। শিশু স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর আইনটির প্রচার বিষয়েও নেই কোনও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তাই ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য বিক্রয় ও বিপণন’ নামের এ আইন যেন অনেকটা কাগজেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর হয়ে গেলেও বিকল্প শিশুখাদ্য আইনের তেমন প্রচার নেই। তাই না জেনেই দোকানে এসব গুঁড়ো দুধ এবং অন্যান্য খাদ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন সাধারণ দোকানিরা। একই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সুপার শপে। শিশুর মা-বাবাসহ অভিভাবকরাও মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে এসব খাদ্যের বিষয়ে সচেতন নন। 
চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, জন্মের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ পুষ্টিকর খাদ্য। বিকল্প হিসেবে গুঁড়ো দুধ শিশুর জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ দুধ নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। শিশু ঘন ঘন অসুস্থ হয়, শারীরিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না। বাজারে সাধারণত দুই ধরনের বিকল্প শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। একটি শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছর বয়সী শিশুদের জন্য ‘বিশেষ ফর্মুলায়’ তৈরি গুঁড়ো দুধ। অন্যটি ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার হিসেবে দেয়া ‘ফর্মুলা ফুড’। 
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এমনিতে যেকোনও খাদ্যে পুষ্টিগুণ থাকলে তা মানসিক বিকাশে সাহায্য করবে। কিন্তু দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চার বিকাশের জন্য বিকল্প শিশুখাদ্যের কোনও গুরুত্ব নেই। এজন্য মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। মায়ের বুকের দুধে যে পুষ্টি আছে, এর কাছাকাছি পুষ্টি অন্য কোনও খাবারে নেই। তবে মায়ের অসুস্থতা বা মা এমন কোনও ওষুধ খাচ্ছেন, যাতে শিশুকে বুকের দুধ দেয়া যাবে না- এমন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

জন্মের পর শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করার উদ্যোগ রয়েছে সারাবিশ্বে। ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা তৈরি করে, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত। সেই নীতিমালার আলোকে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর আইনটি সংশোধন করা হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিকল্প খাদ্যের বিপণন নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে আইনে।

বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) নিজস্ব উদ্যোগ এবং সরকারের সহযোগিতা নিয়ে বিকল্প শিশুখাদ্যের বিপণন কার্যক্রম তদারক করে থাকে। বিবিএফের চেয়ারপার্সন ডা. এস কে রায় বলেন, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ শিশু জন্মায়। তাই বছর ঘুরতেই দুই বছর বয়সী বাচ্চার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক শিশুর প্রত্যেককে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। অভিভাবকদেরই এ বিষয়ে অসচেতনতা রয়েছে। তাছাড়া আইনের প্রচার ও সচেতনতা কার্যক্রম লোকবল ও অর্থ বরাদ্দের ওপর নির্ভর করে। সরকার বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ সংক্রান্ত প্রচার বাড়ানোর জন্য বিবিএফ এবং জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছর মেয়াদী একটি কর্মকৌশল তৈরি করছে বলে জানান তিনি।