ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৫৮০

চাকরি বাঁচাতে ভারতে জরায়ু কেটে ফেলছেন হাজারো নারী

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২১:০৫ ৮ জুলাই ২০১৯  

ভারতে হাজার হাজার নারী অস্ত্রোপচার করে জরায়ু ফেলে দিচ্ছেন। এদের মধ্যে অল্পবয়সী তরুণীরাও রয়েছেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে মাসিক বা রক্তস্রাব একটি ট্যাবু। এসময় নারীদের অপবিত্র ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণের অনুপযোগী বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই গৎবাঁধা ধারণাকে শহুরে শিক্ষিত নারীরা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন।

তবে সাম্প্রতিক দু'টো প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশটিতে ঋতুস্রাব নিয়ে নারীদের সংকট বা ভোগান্তি চলছেই। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার নারী অস্ত্রোপচার করে জরায়ু ফেলে দিচ্ছেন। তরুণী-কিশোরীরাও সেই পথে হাঁটছেন।

চাউর হয়েছে, আখের ক্ষেতে ভাড়াটে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুবিধার্থে নিজেদের জরায়ু ফেলে দিচ্ছেন তারা। প্রতিবছর ওসমানাবাদ, সাংলি সোলাপুরসহ আরও কিছু জেলা থেকে দরিদ্র পরিবারের হাজার হাজার মানুষ যেখানে প্রচুর পরিমাণে আখের ক্ষেত রয়েছে সেখানে তা কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়।

নারীরা কাজে গেলে অনেক সময়ই স্থানীয় ঠিকাদারদের শোষণ নিপীড়নের শিকার হন। এমনকি তারা নারীদের নিয়োগ দিতেও গড়িমসি করে। অজুহাত হিসেবে বলে, মাসিকের সময়ে নারীরা আখ কাটার পরিশ্রম সাধ্য কাজ করতে পারবে না।

পিরিয়ডের সময় ব্যথার কারণে কোনও নারী কাজে যোগ দিতে না পারলে তাদের অর্থ কাটা যায়। আখ শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করতে দূর-দূরান্তে যায়, তাদের বসবাসের পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। মাঠের কাছাকাছিই তাঁবুতে তাদের দিনযাপন। এমনকি অনেক যায়গায় শৌচাগারও থাকে না। আর আখ কাটার ভর-মৌসুমে তো রাতেও কাজ করতে হয়। তাই, কে কখন ঘুমাতে যাবে কখন উঠবে এর কোনও ইয়ত্তা নেই।

এমন বিরূপ পরিবেশে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বহু নারীরা সংক্রমণে আক্রান্ত হন। এমতাবস্থায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে অসাধু অনেকে নারীদের ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তোলার বদলে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেয়।

মহারাষ্ট্রের অনেক জায়গাতেই অল্পবয়সী নারীদের বিয়ে হয়। আর অল্প বয়সেই তারা একাধিক সন্তানের জননীও হয়ে যান। এমনকি বয়স ২৫ হওয়ার আগেই দুই বা তিন সন্তানের মা হয়ে যান কেউ কেউ। অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দিলে নারীরা কী ধরনের সমস্যায় পড়বেন, কী ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে - সেগুলো নিয়েও ডাক্তাররা কিছু বলেন না।

এইভাবে এখন মহারাষ্ট্রের কোনও কোনও গ্রামে প্রায় সব নারী জরায়ু ফেলে দেয়ায় বেশ কয়েকটি গ্রাম 'জরায়ুবিহীন নারীদের গ্রামে' পরিণত হয়েছে। বিষয়টি গত মাসে সংসদ সদস্যদের গোচরে এনেছেন আইন প্রণেতা নীলম গোড়ি। মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একনাথ সিন্ধী স্বীকার করেছেন, গত তিন বছরে ,৬০৫ জন নারী জরায়ু ফেলে দিয়েছেন।

জরায়ু ফেলে দেওয়ার পর থেকে কোনও কোনও নারী স্বাস্থ্য সমস্যায় নিপতিত হয়েছেন। একজন বলছিলেন, তার ঘাড়, কোমর হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করেন। আরেক নারী জানালেন, সকালে ঘুম থেকে উঠার পর তাদের হাত পা মুখ ফুলে যায়। শুধু আখ-শ্রমিকরাই নয়, ঋতুস্রাব নিয়ে তামিল নাড়ুতে সংকটে আছেন ভারতের মাল্টি তৈরি-পোশাক কারখানাতেও।

ঋতুস্রাবের সময় নারী শ্রমিকদের ব্যথা হলে অনেক কারখানাতেই লেবেল ছাড়া ওষুধ খেতে দেয়া হয়। ওষুধ খাইয়ে তাদের কাজ করতে পাঠানো হয়। কারণ কাজ থেকে ছুটি নিলে বেতন কাটা যায়। কিন্তু দরিদ্র পরিবার থেকে গার্মেন্টসে কাজ করতে আসা নারীরা তাদের অর্থ গচ্ছা দিতে পারেন না।

 

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা মোট ১০০ জন নারীর শ্রমিকের সাথে কথা বলেছেন। সাক্ষাতকার দেয়া প্রতিটি শ্রমিকই বলেছেন, তারা ওষুধ খেয়েছেন। আর এদের অন্তত অর্ধেক নারী বলেছেন, ওষুধ সেবনের পর তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।

এসব ওষুধ খাওয়ানোর সময় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও তাদের জানায়নি গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ। মহারাষ্ট্রের বিদ্যমান পরিস্থিতিকে অত্যন্ত 'করুণ দু:খজনক' বলে উল্লেখ করেছেন ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন।

২০০৫-০৬ সালে যেখানে কর্মক্ষেত্রে ৩৬% নারী ছিল, সেটি ২০১৫-১৬ সালে ২৫. শতাংশে নেমে এসেছে। ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর আরও কিছু দেশে নারীরা ঋতুস্রাবের সময় অফিস ছুটি পায়।

এমনকি ভারতের বিহারেও নারীরা মাসিকের জন্য মাসে দুই দিন অতিরিক্ত ছুটি পায় বলে জানিয়েছেন পাবলিক পলিসি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উর্বশী প্রসাদ। ঋতুস্রাব চলাকালীন সুবিধাদি দেয়ার জন্য গত বছর ভারতের সংসদে মেনিস্ট্রুয়াল বেনিফিট বিল নামে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন একজন নারী সাংসদ।

মেনিস্ট্রুয়াল বেনিফিট বিলটি কার্যকর হলে হয়তো গার্মেন্টস কর্মীরা কিছুটা সুবিধা পাবেন। কিন্তু আখের ক্ষেতে ভাড়াটে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করতে যায়, তাদের ভোগান্তির অবসান হবে না। তাদের ভাগ্য নির্ভর করবে ঠিকাদারের মর্জির উপরেই।