ঢাকা, ১৯ মার্চ মঙ্গলবার, ২০২৪ || ৫ চৈত্র ১৪৩০
good-food
১২৮২

যেভাবে এত পরিচ্ছন্ন দেশ হয়ে উঠলো জাপান?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:৪৭ ৩০ নভেম্বর ২০১৯  

সারাদিনের সব ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা স্কুল ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন বাড়ি যাবে। তারা ধৈর্য্য সহকারে শুনছে শিক্ষক পরবর্তী দিনের সময়সূচী সম্পর্কে কিছু বলছেন। শিক্ষকের শেষ শব্দগুলো ছিল-ওকে, সবাই শোনো আজকের ক্লিনিং রোস্টার। প্রথম ও দ্বিতীয় সারি শ্রেণীকক্ষ পরিষ্কার করবে। তৃতীয় ও চতুর্থ করিডোর, সিঁড়ি আর পঞ্চম লাইনে যারা আছো, তারা টয়লেটগুলো পরিষ্কার করবে।
পঞ্চম সারি থেকে কিছুটা কান্নার মতো শব্দ এলেও শিশুরা উঠে দাঁড়ালো এবং ক্লাসরুমের পেছনে রাখা সব উপকরণ নিয়ে টয়লেটের দিকে দৌড়ে গেলো। এটি জাপানে সারাদেশের স্কুলগুলোর একটি পরিচিত দৃশ্য। এদেশে যারা প্রথমবার বেড়াতে যান তারা অবাক হন কীভাবে দেশটি এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলো। চলতে ফিরতে গিয়ে দর্শনার্থীরা দেখেন, কোথাও ময়লা ফেলার ডাস্টবিন নাই এবং চোখে পড়ে না পরিচ্ছন্নতা কর্মীও।
তাহলে এত পরিষ্কার কীভাবে ?
এর সহজ উত্তর হলো জনগণই জাপানকে পরিচ্ছন্ন রাখে। দেশটির হিরোশিমার সরকারি কর্মকর্তা মাইকো আওয়ানে জানান, ১২ বছরের স্কুল জীবনে, এলিমেন্টারি থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের রুটিনে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার জন্য সময় দেয়া থাকে। বাসা বাড়িতে বাবা মা সন্তানদের শিক্ষা দেন, নিজেদের ব্যবহার্য জিনিস ও থাকার জায়গা নিজেরাই পরিষ্কার না করাটা খারাপ।
ফ্রিল্যান্সার অনুবাদক চিকা হায়াশি, আমি কখনো কখনো স্কুলের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নিতে চাইতাম না। কিন্তু পরে আমি মেনে নেই, কারণ; এটা আমাদের রুটিনের অংশ ছিল।
স্কুলে পৌঁছেই শিক্ষার্থীরা জুতা খুলে লকারে রেখে দেয়। আবার বাড়িতেও প্রবেশ পথেই জুতো রেখে ভেতরে প্রবেশ করে সবাই। এমনকি বাড়িতে কাজের লোক এলেও তাই করে থাকে। বাচ্চারা বড় হওয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে ক্লাস রুম, নিজের বাড়ি, পাড়া , শহর এবং দেশ নিয়ে ধারণা পেতে থাকে।
জাপানে পরিচ্ছন্নতার কিছু কিছু ঘটনা ভাইরাল হয়ে গেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে জাপানের খেলা শেষে সমর্থকদের স্টেডিয়াম পরিষ্কার করার ঘটনা বিশ্বকে আলোড়িত করে। খেলোয়াড়রাও ড্রেসিংরুম ছাড়ার আগে সেটি পরিষ্কার করে রাখে। ফিফার কর্মকর্তা প্রিসিলা জানসেনস টুইট করেন, সব টিমের জন্য এটা দারুণ অনুকরণীয়।
ঘাসগুলো সবুজ...পরিষ্কার
মাইকো আওয়ানে বলছেন, আমরা জাপানিরা অন্যদের কাছ আমাদের ভাবমূর্তির বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর। আমরা চাই না কেউ আমাদের খারাপ ভাবুক।
একই দৃশ্য দেখা গেছে জাপানিজ মিউজিক ফেস্টিভ্যালেও। ফুজি রক ফেস্টিভ্যাল জাপানের সবচেয়ে বড় ও পুরনো সঙ্গীত উৎসব। ডাস্টবিন খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বর্জ্য সঙ্গেই রাখেন ভক্তরা।  ধুমপায়ীদের পোর্টেবল অ্যাশট্রে নিয়ে আসতে বলা হয়। যাতে অন্যরা সমস্যায় না পড়েন। আবার সকাল ৮টায় দেখা যাবে অফিস কর্মীরা বা দোকানের কর্মীরা নিজেদের কর্মস্থলের সামনেও রাস্তাও পরিষ্কার করছেন।
অদৃশ্য ময়লা আবর্জনা
বাচ্চারা স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কমিউনিটি ক্লিনিং-এ অংশ নেয়। স্কুলের কাছে রাস্তা থেকে ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলে তারা। সড়ক সংলগ্ন অধিবাসীরাও একাজে অংশ নেন। ঘরের সামনের সড়কের ময়লা সরাতে কারও জন্য অপেক্ষা করে না তারা। অদৃশ্য ময়লা, জীবাণু কিংবা ব্যাকটেরিয়া- এগুলোও আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। কেউ তাই ফ্লুতে আক্রান্ত হলে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করে। যাতে অন্যরা আক্রান্ত না হয়।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
গরমের সময় জাপানে আর্দ্রতা অনেক বেড়ে যায়। খাদ্যদ্রব্য দ্রুত নষ্ট হয়ে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। সেই কারণে হাইজিনকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়। বৌদ্ধ ধর্মে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে রান্না আর পরিচ্ছন্নতা আধ্যাত্মিক বিষয় বলে বিবেচিত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম আসার আগে থেকে জাপানিদের একটি নিজস্ব ধর্ম আছে। সেটা হলো শিনতো। এর মূল মর্মবাণীই হলো পরিচ্ছন্নতা।
ধর্মীয় পরিশুদ্ধতা
বৌদ্ধ ধর্মে পরিচ্ছন্নতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে জাপানিরা এটি এমনিই চর্চা করেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটা আপনাকে পরিশুদ্ধ করে এবং সমাজের জঞ্জাল থেকে মুক্ত রাখে। সেই কারণেই জাপান এত পরিচ্ছন্ন। শিনতো উপাসনালয়ে আসার পর ভক্তরা শুরুতেই হাত ও মুখ ধৌত করেন। এমনকি অনেক জাপানি নিজেদের নতুন গাড়িও উপাসনালয়ে নিয়ে যায় ধর্মযাজকের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করাতে। আপনি যদি জাপানে বাস করতে শুরু করেন কিছুদিনের মধ্যে আপনিও পরিচ্ছন্ন জীবনধারা আত্মস্থ করে ফেলবেন।