ঢাকা, ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
১৩১৮

জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নন নারীরা

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশু বিস্ফোরণ

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১০:৩২ ২৬ আগস্ট ২০১৯  

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারীদের মোটেও আগ্রহ নেই জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৮০ জন শিশু। এর বেশিরভাগই ক্যাম্পে। কিছু সংখ্যক হাসপাতালে। 
২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা চালানো হয়। এজন্য বিভিন্ন উপকরণও তাদের দেয়া হয়। কিন্তু নিজ দেশে এ নিয়ে তাদের কোনও অভিজ্ঞতা না থাকায় চেষ্টা করেও তাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে তাদের কোনও সচেতনতা নেই, আগ্রহও নেই।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রাখাইনের রোহিঙ্গারা। দেখতে দেখতে এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার পেরিয়ে গেছে দুটি বছর। যদিও আগেও তারা বাংলাদেশে এসেছে, তবে ব্যাপকভাবে আসতে শুরু করে ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট থেকে।
এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে ১৯৬৮ সাল থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত রয়েছে আরও অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গা। 
বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের ৩২ টি ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। নতুন পুরাতন মিলে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে গেল দুই বছরে জন্ম নেয়া প্রায় ৯১ হাজার শিশু।

বর্তমানে ২০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী সন্তানসম্ভবা। ফলে আগামী এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র জনসংখ্যা বিষয়ক রিপোর্ট এবং বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে এসব  তথ্য।  
টেকনাফ ক্যাম্পে কর্মরত ডা. আয়েশা কবির বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের প্রবণতা অনেক বেশি। ২০ বছরের একজন রোহিঙ্গা নারীর অন্তত তিনটি করে সন্তান আছে। পরিবার-পরিকল্পনার কথা বললেও তারা রাজি হয় না। বরং ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। একেকটি রোহিঙ্গা পরিবারে পাঁচ-ছয়জন শিশু আছে। কারণ প্রত্যেক শিশুর জন্যই কার্ড পাওয়া যায়। যে কার্ড দেখিয়ে খাবার, ওষুধ ও কাপড়সহ নানারকম সুবিধা পাওয়া যায়।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের সংখ্যাও কম। তাদের মধ্যে নেই কোনও আগ্রহ। এক একটি পরিবারে সদস্য সংখ্যা গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন।

ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি। শিশুদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুর হার ২৩ শতাংশ, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ২১ শতাংশ এবং ১ বছরের কম বয়সের শিশুর হার ৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি । অনেকে আবার এখানে এসে ক্যাম্পে বিয়ে করেছেন। এসব রোহিঙ্গা নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের আগ্রহ একেবারেই কম বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক ডাক্তার পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য্য।

তিনি বলেন, সরকারি বেসরকারি ১২০টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে এসব রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।

ইউএনএইচসিআরের জনসংখ্যা বিষয়ক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন গণমাধ্যমকে জানান, গত ২ বছরে ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৯১ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। তারমধ্যে ১ বছরের নিচে রয়েছে ৩১ হাজার শিশু। আর দু বছরের নিচে রয়েছে ৬০ হাজার শিশু। জনসংখ্যা রোধ করতে ক্যাম্পগুলোতে নানা কার্যক্রম চলছে বলেও জানান তিনি।


কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মতিন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন কত শিশুর জন্ম হচ্ছে সে বিষয়ে পুরোপুরি সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউএনএইচআরসি এবং ইউনিসেফের সার্ভেতে বলা হচ্ছে, প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৮০ থেকে ৮৫ জন শিশুর জন্ম হচ্ছে। সে হিসাবে এক বছরে ৩০ থেকে ৩২ হাজার আর দুই বছরে ৬০ থেকে ৬৪ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৭০ জন শিশুর জন্ম হচ্ছে। কিছু শিশুর জন্ম হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে, কিছু সদর হাসপাতালে।

দুই বছর আগে যখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আসা শুরু করে, তখন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডা. আব্দুস সালাম। এখন তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক উপ-পরিচালক। ডা. আব্দুস সালাম বলেন, যদি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে ১০ লাখ রোহিঙ্গা থাকে, তাদের মধ্যে মাসে তিন শতাংশ নারী গর্ভধারণ করে।

পরিবার পরিকল্পনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমদিকে তাদের খাবার জন্য পিল দেয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটা তারা গ্রহণ করেনি, ঘরে নিয়েই ফেলে দিতো। আমরা দেখেছি, সেসব ওষুধ তাদের ঘরের চারদিকে পড়ে আছে। পরে তাদের একটা ইনজেকশন ফর্মের আওতায় আনা হলো, তাতে কিছুটা কাজ হচ্ছিলো, গ্রহণও করেছিল কিছুটা। কিন্তু সরকার থেকে সেটা পুরোটা সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমরা ফ্যামিলি প্লানিং কার্যক্রম ঠিকমতো জোরদার করতে পারিনি।

বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম জোরদারের চেষ্টা করছে ইউএনএফপিএ। তারা ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের কিটস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রোডাক্ট দিচ্ছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুরু থেকেই কাজ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। আইইইডিসিআর-এর জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, শুরু থেকেই তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছিলো। আমরা তাদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি ইমপ্ল্যান্ট সাজেস্ট করেছিলাম। সেই দুই বছর আগে থেকেই তাদের বোঝানোর জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। নিজ দেশে তাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং বলে কিছু ছিল না এবং তারা এতে অভিজ্ঞও ছিল না। যার কারণে তাদের এ পরিকল্পনার মধ্যে আনাটা খুব কঠিন।

এদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নয় বলেও ক্যাম্পের উইম্যান ফ্রেন্ডলি স্পেসে বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নারীরা।

সরকারি হিসেবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় দুই বছরে মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে কক্সবাজারে পালিয়ে এসেছিল ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। গণহত্যা, ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া, জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা, নারীদের ধর্ষণসহ ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয় ওই রোহিঙ্গারা। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীসহ সন্ত্রাসীদের হাতে প্রচুর সংখ্যক নির্যাতিতা নারী। ধর্ষণের শিকার তরুণীর সংখ্যাও অনেক। তবে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।

তাদের অনেকেরই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে। কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়ার প্রথম তিন মাসেই ৩৪ হাজার ৪৮০ জন গর্ভবতী নারী শনাক্ত করা হয়।

রোহিঙ্গা সমস্যার শুরুতে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ১৩০টি শিশু জন্ম নেবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করলেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুসারে এ সংখ্যা শতাধিক হবে না। জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশন ও ইউএনএইচসিআর-এর হিসেবে টেকনাফ ও উখিয়া এই দুই উপজেলার ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৯২টি শিশু। এই হারে প্রতিমাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন মুখ যোগ হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে যে সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছে এদের মধ্যেও ২ লাখ ৪০ হাজার শিশু-কিশোর রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যাবাসনকাল বেশি দীর্ঘ হলে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশু ও এখানে বড় হওয়া শিশু-কিশোরদের নাগরিকত্ব নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।

কিছু এনজিও রোহিঙ্গা শিশুদের এবং মায়েদের জন্য সামান্য পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তাদের সন্তান প্রসবে উৎসাহিত করছে। তারা মনে করছে, সন্তান হলেই তার জন্য আলাদা ভরণপোষণ পাওয়া যাবে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তারা সেটি মানছে না।

আরও একটি বিষয় আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এবং এখানে শিশু-কিশোর বয়স থেকে বেড়ে ওঠা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে কি না? সবকিছু মিলিয়ে অধিক হারে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুদের নাগরিকত্ব বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মসূত্রে বাংলাদেশি বলা যাবে না। আর সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। বিষয়টি সরকারের রোহিঙ্গাবিষয়ক নীতির ওপর নির্ভর করছে।