ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর রোববার, ২০২৪ || ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৫২৯

প্রথম হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, আজ তিনি বঙ্গভবনের পথে

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৭:০৯ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম চূড়ান্ত করেছেন। রবিবার সকালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে আওয়ামী লীগ তাঁর নাম জমা দেয়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

 

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে মনোনয়ন প্রদান করেছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি, আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল গত ৭ ফেব্রুয়ারি বৈঠকে সংসদীয় দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তিনি এ মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন।’

 

ওবায়দুল কাদের সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতির পরিচয় তুলে ধরে বলেন, ‘মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন পেশায় একজন আইনজীবী এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য। তিনি ১৯৪৯ সালে পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এর আগে জেলা, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।’

 

মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮২ সালে তিনি বিসিএস ক্যাডার হিসেবে বিচার বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৯৫ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।

 

এক লেখায় সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ আসলেই তাঁর সঙ্গে কাটানো কয়েকটি মুহূর্ত স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। আমি সৌভাগ্যবান যে, আমার রাজনীতির হাতেখড়ি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে হয়েছিল। তার ডাকে সাড়া দিয়েই ১৯৬৬ সালে নিজেকে ছাত্রলীগের ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আবিষ্কার করেছিলাম।

 

৬ দফার প্রচারণা চালাতে (টাউন হলে জনসভার মাধ্যমে) এদিন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাসায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানেই প্রথম দেখা। ভাতিজা সুবাদে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী আমাদের প্রিয় চাচা জনাব এম মনসুর আলী, এম এইচ কামরুজ্জামানসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বগা চাচা। সেই পরিচয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বভাবসুলভ আদরের ‘তুই’ সম্বোধন। 


সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘মাঠে (সভাস্থল) আয়।’ সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনও কলেজের তকমা পাইনি। রাজনীতির কতটুকুই বা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দীর্ঘদেহী এই মানুষটির  স্নেহমাখা ‘মাঠে আয়’ স্বরে কী যে লুকিয়ে ছিল! তা আজও ভুলতে পারি না। সাউন্ডটা কানে বাজে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম- কেউ না নিলেও একা একা জনসভায় যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না। সবার সঙ্গেই টাউন হলে গেলাম।

 

বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধ শ্রোতা থেকে গগনবিদারী স্লোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর ‘মাঠে আয়’ নির্দেশের মধ্য দিয়ে হয়েছে। এরপর আর পেছনে তাকাইনি। 

 

কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন; সেটাই যে আমাকে পরবর্তীতে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ যুগিয়েছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

১৯৬৬’র পর আরো কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। তাঁর প্রগাড় ভালোবাসা, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, অসীম দক্ষতা-যোগ্যতা, বিনয়, কৃতজ্ঞতাবোধ, তেজস্বী ব্যক্তিত্ব সর্বোপরি উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করার আশ্চর্য ক্ষমতা সব সময়ই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করে।

 

বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ৪৪ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ে স্বৈরশাসন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন এবং ওয়ান-ইলেভেন এসেছে। রাজনৈতিক জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কত কিছু শিখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকার সেই মুহহূর্তগুলো আজও ভুলতে পারিনি।

 

সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ওই লেখায় বলেন, স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্মুখ সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল আমার। যার একটি ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন জাতির জনক। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। বক্তৃতা দিলাম।

 

ডায়াস থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু এঁকে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস।’ বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির জনকের দিকে।

 

পরে দু-একটি কথা বলে স্টেজের সাইডে গেলাম। পরে এই ভেবে উৎসাহি হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্ততৃায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।


বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অফ অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামলো পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও।’

 

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।

 

২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ওই লেখায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল পঁচাত্তরে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে। জেলা বাকশালের সম্পাদক ও ৫ যুগ্ম সম্পাদক মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। জাতির জনক সেদিন তাঁর স্বভাব ড্রেসকোড ‘হাফ-শার্ট’ ও ‘লুঙ্গি’ পরে ছিলেন। এই সাক্ষাতের দুই মাস পরেই যে বঙ্গবন্ধু চলে যাবেন, কে জানত সেটা? ভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম। বাকশাল কমিটিতে স্থান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

 

তিনি আমাদের নানা দিকনির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন- ‘কী রে, আমার সাথে তো ছবি না তুলে কেউ যায় না; তোরা কেন যাস।’ তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান ডাকলেন। ফটোবন্দী হলাম ‘রাজনীতির কবি’র সাথে। বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে নেওয়া সেই ছবি আজও আমি আগলে রাখি। তার কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন যে এটাই! 

 

সংক্ষিপ্ত লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ