ঢাকা, ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার, ২০২৫ || ৬ ভাদ্র ১৪৩২
good-food
১২৯১

বাংলাদেশে দুর্গাপূজার উৎস ও সার্বজনীন বিকাশ 

সৈয়দ রাশিদুল হাসান

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৮:৩৯ ৭ অক্টোবর ২০১৯  

হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। সনাতন ধর্মমতে শক্তিশালী অসুর বা অপশক্তিকে বিনাশ বা বধ করেছিলেন, জীবের দুর্গতি তথা যে ত্রিতাপ, আদি ভৌতিক, আদি দৈবিক, আধ্যাত্মিক জ্বালা যা জীব ভোগ করে, তা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন জীবকে, তাই তিনি দুর্গতিনাশিনী দুর্গা অর্থাৎ পরম শান্তি। একটা সময় ছিল যখন পূণর্জাগরণবাদী ও ধর্ম শুদ্ধিকরণ আন্দোলন প্রখর হয়ে ওঠেনি, তখন এই বাংলায় দুর্গাপূজায় ধর্ম জাত ভেদাভেদ ভুলে আপামর গ্রামবাসী উৎসবে মিলিত হতো।
গ্রামের জমিদার বা ধনী গৃহস্থ পূজার সঙ্গে নানা ধরনের বিনোদনের আয়োজন করতেন, থাকতো ভোজ, থিয়েটার, সংকৃর্তনসহ নানা অনুষ্ঠান। ধর্মীয় ভেদাভেদ প্রখর না থাকায় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিপত্যের কারণে ও সামাজিক কারণেও যোগ দিতেন সবাই, আর কিছু না হোক ওই একটি দিন গ্রামীণ জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেত গ্রামবাসী। 
দুর্গাপূজার উৎস নিয়ে প্রচুর তর্ক বিতর্ক রয়েছে। সে কারণে দুর্গাপুজোর উৎস ও সর্বজনীন বিকাশের ইতিহাস হয়ে উঠেছে অতি জটিল।
যেমন পুরাণে বলা হয়েছে, বসন্তকালে রাজা সুরথ করিয়েছিলেন দুর্গাপূজা, এখন সে পূজার পরিচিতি বাসন্তী পূজা নামে। আবার কৃত্তিবাসের রামায়ণে শরৎকালে রামকে দিয়ে অকালবোধন করিয়ে দুর্গাপূজা করানো হয়। বিখ্যাত পন্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ দুর্গাপুজোকে একেবারে নিয়ে গেছেন প্রাচীনকালে। তার মতে, একসময় প্রাচীনকালে রাজ্যজুড়ে অজানা বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, তখন ঋষি মনিরা আগুন না জ্বালিয়ে ধ্যান করতেন, তবে বেদি রক্ষা রাখতেন, যখন আবার বিপর্যয় কেটে গেল, তখন অগ্নির নিকট হবি প্রভৃতি দানের দরকার হল, কিন্তু তারা আগুন না জ্বালিয়ে সেখানে দক্ষকন্যা বা কুন্ডের ওপর পীত বর্ণের মূর্তি স্থাপন করলেন। মূর্তিটি ছিল অগ্নির প্রতীক এবং তার নামকরণ করা হয়েছিল হব্যবাহনী। পরে এই মূর্তিটি পরিণত হল দূর্গায়। 
কুন্ডের দশদিক দুর্গার দশ হাত, বৈদিক যুগের শেষ দিকে দেখা যায় দক্ষকন্যা ক্রমশ উমাতে পরিণত হলেন, উমা আম্বিকায় এবং আম্বিকা দুর্গায়, এ সময় আর যজ্ঞ বেদী রইল না। 
তবে দূর্গা পূজা সম্পর্কে যারাই আলোচনা করেছেন তারা একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, দুর্গাপূজা অতি প্রাচীন অনুষ্ঠান। কত প্রাচীন তা অবশ্য নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
রমাপ্রসাদ চন্দ মনে করেন সম্ভবত তামসী পূজায় এই উৎসবের সূত্রপাত এবং সাত্ত্বিকী পূজায় এর চরম পরিনতি। তার মতে, সভ্যতার তিনটি পর্যায়ে মানুষ তিন ধরনের পূজা করতেন। সাত্ত্বিকী পূজায় দেয়া হয় নৈবদ্য, তবে তা আমিষ নয়, করা হয় জপ ও যজ্ঞ। রাজসী পূজায় দেয়া হত বলি এবং নৈবদ্য হত আমিষের। তামসী পূজায় জপ, যোজ্ঞ, মন্ত্র কিছুই লাগত না তবে নৈবদ্যে দেয়া হতো মদ মাংস। 
রমাপ্রসাদ চন্দ আরো বলেন, বাঙালি সভ্যতার ইতিহাস দুর্গোৎসব সাথে জড়িত। বাঙালি যদি নিজেকে ভালো করে জানতে চায় তাহলে তাকে দুর্গা উৎসবের ইতিহাস অনুশীলন করা উচিত। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন দুর্গাপূজা আমরা যত প্রাচীন উৎসই খুঁজি না কেন, সবচেয়ে প্রাচীন যে মহিষমর্দিনী মূর্তিটি পাওয়া গেছে তা পঞ্চম শতাব্দীর।
অন্যদিকে, যোগেশচন্দ্র বাগল তার লেখায় দুর্গা পূজা নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন যে, দুর্গাপুজোর পুরো ব্যাপারটি জটিল হয়ে পড়েছে। কারণ এর "আনুষাঙ্গিক অসংলগ্ন অঙ্গ দেখিলে মনে হয়" এক দেশে তা  "প্রবর্তিত ও বর্ধিত" হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন আচার বিধি বিভিন্ন সময় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। 
তিনি মনে করেন অম্বুবাচীর ভদ্রকালী পরে রূপান্তরিত হয়েছেন দূর্গায়। দূর্গা পূজার আগে পূজা হত ভদ্রকালীর, পরে শরৎকালের শুরু হয়েছে দুর্গাপূজা এবং দশভূজা দুর্গা প্রতিমার রং হবে অতসী পুষ্প অনিল। অতসী পুষ্প বাংলাদেশের পরিচিত তিসি হিসেবে। তিনি অবশ্য এই ও উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ভুলে শন-পুষ্পী অতসী হিসেবে পরিচিত। তবে কোনভাবেই প্রতিমা 'চম্পকবর্ণা' হবে না, কারণ, তা অশাস্ত্রীয়।

বলতে পারেন, প্রাচীনকালে দুর্গাপূজা হয়তো হতো, তবে তার প্রকৃতি ও রূপ ছিলো ভিন্ন। এখন প্রচলিত দুর্গাপূজো প্রাচীন পদ্ধতির লৌকিকরুপ যা বর্তমানে শারদীয় উৎসব। আশ্বিনের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে অকাল বোধন হয় দুর্গার। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিন দূর্গা পূজা। দশমীতে হয় বিসর্জন। 
বাংলাদেশে দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে উৎসব ও সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিনত হয় ভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে। তবে, বাংলায় একসময় দুর্গাপূজায় হিন্দুদের সর্বজনীন এবং বড় পূজা ছিল বলে মনে করা হয় না। 
বিভিন্ন তথ্য দেখে মনে হয়, কয়েকশো বছর আগে দুর্গাপূজা বাংলায় চরমতম স্থান দখল করেছে, দুর্গাপূজা বাংলায় কখন শুরু হয়েছে সে বিষয়ে গবেষক ও পন্ডিতগণ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, আকবরের চোপদার রাজা কংসনারায়ণ (তাহিরপুরের রাজা নামে খ্যাত ছিলেন) ষোড়শ শতকে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হন। দেওয়ান হওয়ার পর কংস নারায়ণ মহাযজ্ঞ করতে চাইলেন। রাজার পুরোহিত ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী তিনি রাজা কে জানান, যে চার রকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে, তার কোনটিও এ আমলে করা সম্ভব নয়। তিনি রাজাকে বরং দুর্গা পূজা করতে বলেন এবং তিনি দুর্গোৎসব কি পদ্ধতিতে হবে তাও লিখে দিয়েছিলেন। 
সে সময় রাজা কংসনারায়ন প্রায় আট থেকে নয় লাখ টাকা খরচ করে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা উদযাপন করেন। বলতে পারা যায়, সেই থেকে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু। তবে সামগ্রিকভাবে দুর্গাপূজাকে বড় উৎসবে পরিণত হতে আরো কয়েকশো বছর লেগে যায়। উনিশ শতকের ত্রিশ দশকের আগেও দুর্গাপূজা বাংলায় অত বড় উৎসব হয়ে ওঠেনি।
তবে এটা বলা বাহুল্য যে, আগের দুর্গা উৎসব আর এখনকার দুর্গোৎসব অনেক তফাৎ রয়েছে। আগের পূজা ছিল মানসিক, এখনকার পূজা হয়েছে তামসিক। নাচ গান তামাশা এই হল এখনকার পুজো। শোক, মোহ, মায়া, অজ্ঞান আধ্যাত্মিক জ্বালা দ্বারা আবদ্ধ। উনিশ শতকের ত্রিশ চল্লিশের দশকের দিকে বাংলায় গ্রাম গঞ্জে ব্রাক্ষ্মণবাদের বিরুদ্ধে জাগরণ ঘটে, তখন দুর্গা উৎসবের নিয়ন্ত্রণ বাবুদের হাত থেকে ছিটকে পড়ে। 
অধ্যাপক যতীন সরকার তাদের গ্রামের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার বিবরণ দেন, তাদের গ্রাম নেত্রকোনার চন্দপাড়ায় দেবেন্দ্র দাস নামে অব্রাহ্মণ উপনয়ন ধারণ করে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে ঘোষণা করেন। ফলে সমস্ত ব্রাহ্মসমাজ তাকে একঘরে করার চেষ্টা করে। দেবেন্দ্র তখন নিজেই প্রতিমা নির্মাণ করেন, নিজেই পৌরহিত্যে নিজ বাড়িতে পূজা শুরু করেন এবং তার বাড়ির পূজা ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার ই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে এরকম কয়েকজন অব্রাহ্মণ বিদ্রোহ করে বসেন এবং পুরোহিত ছাড়াই তারা দূর্গা পূজার অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এমনটি ঘটেছিল তা জানা যায়নি। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করেছিলেন তার বিভিন্ন প্রমাণ আছে। দেশ ভাগের আগ মুহূর্তে বিভিন্ন দাংগা ও দেশে ভাগ হবার পর বাবুদের দেশান্তরি। ফলে একক ভাবে পূজা উদযাপন করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চাশের দশকের দিকে বর্ণ বিভেদ ভুলে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ একত্রিত হয়ে চাঁদা তুলে পূজার অনুষ্ঠান শুরু করে, যা এখন "সর্বজনীন পূজা" হিসেবে পরিচিত। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল একদম নতুন, যা আগে কখনোই চিন্তা করা হয়নি । পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যত দূর্গা উৎসব হয়েছে, তার সব ই ছিল সার্বজনীন দুর্গাপূজা। এর কেন্দ্র হয়ে ওঠে ঢাকেশ্বরী মন্দির। কিন্তু ব্যক্তি বা পরিবার কেন্দ্রিক পূজো যে হয়নি তা কিন্তু নয়।
সর্বজনীন বা ব্যক্তি কেন্দ্রিক যেভাবেই হোক না কেন, পূজা, তা যে বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে, আর রুপ নিয়েছে সম্প্রীতির উৎসব হিসেবে; তা নিয়ে আজ আর কোন সন্দেহ নেই। এ উৎসব সব সময় সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ বিনয়ের সাথে গ্রহণ করে।
 

ধর্ম বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর