ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৬৮

আস্থার নাম ‘কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টার’

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০৩ ২৯ ডিসেম্বর ২০২০  

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রসঙ্গত আল বেয়ার কাম্যুর প্লেগ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যে উপন্যাসের মূল চরিত্র ডঃ রু (Rieux) ফ্রান্সের কাল্পনিক ওরান শহরের মহামারি প্লেগের চিকিৎসা করতে গিয়ে বলছেন– ‘I have no idea what’s awaiting me or what will happen when this all ends … For the moment I know this: there are sick people and they need curing.’

 

ঠিক এ মুহূর্তে পৃথিবী সেই সংবেদনশীল অবস্থাতেই এসে দাঁড়িয়েছে; যেখানে মানবসভ্যতা জিম্মি হয়ে আছে কোভিড-১৯ তথা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। এ রাহুমুক্তি যে আশু আসন্ন নয় তা খুব সহজেই অনুমেয়। পরবর্তী পৃথিবী ও সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ণীত হবে এবং মানুষকে বসবাস করতে হবে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সহচর্যে। হিসাব কি বলছে দেখা যাক-

 

CDC (Centers for Disease Control and Prevention)-র মতো আন্তর্জাতিকভাবে মান্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী,  শুধু আমেরিকাতে জুনের ৩ তারিখে (৩.০৬.২০২০)- মোট কনফার্মড করোনা পজিটিভ কেসের সংখ্যা ১,৮৭,০০০০ (প্রায় ২ কোটি), মৃত্যু ১ লাখ ৮০০০-এর বেশি। করোনা আক্রান্ত ১৪% মানুষের মৃত্যু ঘটেছে আমেরিকায়। যদিও ক্ষীণ আশার কথা বিবিসি সংবাদ সংস্থার (২.০৬.২০২০) মার্চ পরবর্তী সময়ে এ প্রথম ইংল্যান্ডে প্রতিদিন যে হারে মানুষের মৃত্যু ঘটছিল, সেটার থেকে মৃত্যুহার কমেছে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুহার ৮০ বছর পেরিয়ে গেলে ৭০ গুণ বৃদ্ধি পায়।

 

অন্যদিকে, সিএনএন সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী-জুন পর্যন্ত  (৩.০৬.২০২০) পৃথিবীতে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬২,০০,০০০। মৃত্যু হয়েছে ৩,৭৬,০০০ জনের। প্রথম স্থানে আমেরিকা, দ্বিতীয় ইংল্যান্ড–আক্রান্ত ২,৭৮,০০০ এবং মৃত্যু ৩৯,৩৬৯ জনের। তৃতীয় ব্রাজিল–আক্রান্ত ৫৫,৮০০ এবং মৃত্যু ৩১,৩০৯।

 

এ তো গেল বৈশ্বিক হিসাব নিকাশের কথা। এবার যদি একটু তাকাই বাংলাদেশের দিকে তাহলে দেখব দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ কি সেটার ভয়াবহতা নিয়ে শিকড় গেঁড়ে বসতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ বসবাস কাঠামো, স্বাস্থ্য কাঠামোর অপ্রতুলতা এবং ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিসহ নানাবিধ কারণে মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে জনসমষ্টি তথা রাষ্ট্র। 

 

আমরা বরং দৃষ্টিপাত করি এমন একটি জনবহুল দেশে করোনা মোকাবেলায় এ করোনাকালীন দুর্যোগে মানুষের কাছে কি উপায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাচ্ছে। করোনার মতো একটি সংক্রমিত ব্যধি যার অন্যতম শর্ত হলো দূরত্ব বজায় রাখা, সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের স্বাস্থ্যগত দিকটিকে সম্পূর্ণ বিবেচনায় রেখে সেটার প্রতি অধিক যত্নশীল হওয়া। 

 

এমনই একটি উপায়ের নাম টেলিহেলথ বা টেলিমেডিসিন। বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন নয়, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মানুষের কাছে সঠিক উপায়ে সেবা পৌঁছে দেয়ার কার্যকরী মাধ্যম বিশেষ। টেলিহেলথের অন্যতম যুগান্তকারী দিক হলো ঘরে বসেই ডাক্তারি সেবা পাওয়া। স্বল্প সময়ে সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিয়তা দেয়া সম্ভব এর মাধ্যমে। 

 

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কতটুকু কার্যকরী হচ্ছে এ টেলিহেলথ সেবা!! তৃণমূল থেকে শুরু করে উঁচুতলার সব মানুষকে কি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে প্রযুক্তির সহজতম আত্তীকরণের দ্বারা একই ছাতার তলে আনতে পারা সম্ভব হয়েছে!! দেখাই যাক, সেটার উপায় উপাত্ত কেমন!!  

টেলিহেলথ সেবার এর মাধ্যমে সরকারিভাবে করোনা মহামারি তথা দুর্বিপাকে যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও এটুআই, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এর যৌথ পদক্ষেপ ‘কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টার’। যার কারিগরি সহায়তায় রয়েছে স্বাস্থ্য বাতায়ন।  

 

করোনা যখন বাংলাদেশ করাল থাবা বসাতে শুরু করে, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও এটুআই’র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে টেলিহেলথ সেবা প্রদানের ভাবনা দানা বাধঁতে শুরু করে, এটুআই আইসিটি ডিভিশনের পক্ষ হতে চীফ স্ট্র্যাটেজিস্ট  ই -গর্ভনেন্স ফরহাদ জাহিদ শেখ আন্তরিক তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে টেলিহেলথ সেবার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।

 

সেই সঙ্গে উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ এর প্রারম্ভিকে  নারায়ণগঞ্জে সংক্রমিতের হার আমরা অনেক বেশি হতে দেখেছি। এমন একটি পরিস্থিতিতে সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম কয়েকজন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে বসেই টেলিহেলথের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া শুরু করেন। মাঠ পর্যায়ের এ অভিজ্ঞতারও সমন্বয় ঘটেছে পরিকল্পনার পরিক্রমে।  

 

অতঃপর নানা তথ্য-উপাত্ত ও পদ্ধতি যাচাই, বাছাই করে, বিভিন্ন পরামর্শ ও মতামতের সন্নিবেশে জনসাধারণের কাছে মহামারী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কিছু মানুষের যৌক্তিক ভাবনার সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। টেলিহেলথ প্রক্রিয়ার দরুণ যার নাম ‘কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টার’। যা যাত্রা শুরু করে ১৩ জুন ২০২০।  


মানুষ তখন আতংকে ব্যতিব্যস্ত, অসুস্থ হলে কোথায় ডাক্তার পাওয়া যাবে এ চিন্তাতেই অসুস্থ হওয়ার সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়।  ডাক্তার পাওয়া যাবে কোথায়,  আবার নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।  শুধু তো ডাক্তার সংকটই নয়, তথ্যগত নানা বিষয় রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য প্রাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটাই বা ঠিকমতো পাওয়া ভার।  

 

এসব দুর্ভোগকে বিবেচনায় রেখে একটি সমাধানের পথ সূচিত হলো ‘কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টার’ এর মাধ্যমে। পরিস্থিতি পরিবেশ ও মানুষের চাহিদাকে মূল্যায়িত করে যেসব সেবা নিয়ে এটি মানুষের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া শুরু করলো, সেবা গুলো হলো:

 

মূল্যায়ন ও পরামর্শ-
রোগের উপসর্গ যাচাই
সেবাদানকারীর পরামর্শ
ই-প্রেসক্রিপশন সেবা 
ডাক্তারের ফলোআপ কল 
জরুরি সেবা সহযোগিতা
করোনা পরীক্ষার অনুরোধ 
হাসপাতালে ভর্তি
অ্যাম্বুলেন্স সেবা 
অন্যান্য সেবা সহযোগিতা 
মৃতদেহ সমাহিত করা
প্রতিরোধমূলক তথ্য  
সতর্কীকরণ তথ্য  
সুস্থতা পরবর্তী সেবা


এ কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টারে দ্বায়িত্বরত ৮০ জন ডাক্তার ও ২০ জন হেলথ ইনফরমেশন অফিসারের সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নিরলস সেবা মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সম্ভব হয়েছে সততার সঙ্গে মানুষকে সাহস দিয়ে, সেবা দিয়ে, যত্ন দিয়ে সুস্থতার দ্বার পর্যন্ত নিয়ে যেতে। 

 

এখন পর্যন্ত ৬,৪৩, ৫০৯টি সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে মানুষের দ্বার প্রান্তে। সেবা পেয়েছেন ২,৩২,৬৬৫ জন করোনা আক্রান্ত মানুষ। সেই সঙ্গে কমিয়ে আনা সম্ভবপর হয়েছে আক্রান্তের মৃত্যুর হার। যখন সারা পৃথিবীতে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুহার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে এর হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে। 

 

বর্তমানে এ মৃত্যু প্রতি ১০০ জনে হার ১. ৪৬ শতাংশ, যা নিঃসন্দেহে অন্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। সুস্থ হওয়ার হার প্রতি ১০০ জনে ৮৮. ৬৬ শতাংশ। শনাক্তের হার প্রতি ১০০ জনে ৬০. ০৮ শতাংশ। সার্বিক এ বিচার আমাদের আশান্বিত করে। সেইসঙ্গে এটিও বুঝতে সহায়তা করে স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও এ টেলিহেলথ প্রয়াস মানুষের দুঃশ্চিন্তা দূরীকরণে একটি বলিষ্ঠ ও কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলছে।  

 

যা পৃথিবীতে এ মুহূর্তে বিস্ময়কর দৃষ্টান্তও বটে। এ প্রচেষ্টার প্রভাব ও ফলাফলের বিচার শুধু সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। বরং এ সেবা প্রদান করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কেমন করে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক নির্মিত হয়েছে, সেটিকে গোচরে এনে মূল্যায়ন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সেবা পৌঁছে দেয়া নয়, প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে তথ্য ও সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে, যা সর্বান্তকরণে একটি সুসংহত টেলিহেলথ পদ্ধতি প্রণয়ন সাপেক্ষে জাতীয় উন্নয়নে তথা টেকসই উন্নয়নে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে। 

 

সেবা প্রদান আর প্রাপ্তি, সেবাগ্রহীতা ও দাতার প্রত্যক্ষ আদান প্রদানের মাধ্যমে সেবা দেয়ার আন্তরিকতা ও চেষ্টার নিরন্তর এই পথচলা খুব স্পষ্ট করে দিক অঙ্গুলি প্রদান করে এই মর্মে, এ সেবার মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের ধারনাটিও নতুনভাবে দেখার একটি সুযোগ ইতিমধ্যেই ঘটেছে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পট উন্মোচন হয়েছে আস্থা বিশ্বাস আর সেবা প্রদানের প্রতিজ্ঞায়।  

জানামতে, দেশের সব শ্রেণির মানুষদের এ ধরনের  টেলি স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার ধারণাটিও বিরল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে কোভিডকালীন এ দুঃসময়ে মানুষ নিবিড়ভাবে সরকারি প্ল্যাটফর্মে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে যাচ্ছে। যার একটি চমৎকার উদাহরণ হলো ‘কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টার’। 

 

যেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ডাটা প্রাপ্তির ভিত্তিতে রোগীদের টেলিফোনে কল করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবাসহ এ যে মানুষ একটি ফোনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কোনও ঝামেলা ছাড়াই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে, সরাসরি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পারছে, তার সংকটে মানুষকে পাশে পাচ্ছে-এ প্রাপ্তি নেহাত অকিঞ্চিকর নয়। বরং অনেক বেশি দরকারি, অনেক বেশি মূল্যবান।    

 

সর্বোপরি বাস্তবতা হলো মানুষ যত্ন চায়, মমতা চায়, সহমর্মিতা চায়। তাই ভবিতব্য জানা না থাকলেও আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সংবেদী সমাজ ও মানুষ-মুখী রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য এমন উদ্যোগ শুধু প্রশংসনীয় নয় বরং অবশ্যম্ভাবী। প্রযুক্তির সহজ ব্যবহারের মাধ্যমে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ধারণ করে সর্বস্তরের মানুষকে সেবা দেয়ার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে ‘কোভিড-১৯ টেলিহেলথ সেন্টার। যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পথচলা নিষ্কন্টক হোক, হোক নিরন্তর। 

 

লেখক - নবনীতা চক্রবর্তী
সেন্টার কো-অর্ডিনেটর,  মা টেলিহেলথ সেন্টার।