ঢাকা, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৬২৮

ই-কমার্সে নারী উদ্যোক্তাদের বিপ্লব

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৮:৫৩ ৫ মার্চ ২০২১  

দেশের নারীরা এখন শুধু ঘরে বসে রান্নাবান্না নিয়েই ব্যস্ত নেই। তারা অর্থ উপার্জন করে পরিবারে অবদান রাখছেন। আয়-উপার্জনের পথ দেখিয়ে চলেছেন আরও ১০জন তরুণী গৃহিণীকে। ডিজিটাল বাংলাদেশে’র সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা ই-কমার্সে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন।

 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক বাজারব্যবস্থা এখন অনেকটাই অনলাইননির্ভর। করোনাকালে এটি প্রমাণ হলো। এসময়ে ঘরে বসেই অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা করছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা পণ্যের বেশ বড় একটি অংশ এখন সরাসরি বাজারে বিক্রি না করে অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে করছেন। এতে তারা পণ্যের যথাযথ দাম পাচ্ছেন। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে গেছে। বলা যায়, এটি একটি নীরব বিপ্লব।


বগুড়ার মেয়ে নাইচ আকতার, স্থানীয় কলেজ থেকে স্নাতক পাস করার পর স্বামী সাজেদুর রহমানকে নিয়ে বাড়ির পাশের ২০ শতক জমিতে শুরু করেন কৃষিকাজ। প্রথমে পেঁপে চাষ সঙ্গে হাঁস-মুরগি ও গাভী পালন শুরু করেন। আর পারিবারিকভাবে মা-খালার কাছে শেখা সেলাই এবং হাতের কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

 

উৎপাদিত ফসল তার স্বামীর মাধ্যমে প্রথমে স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হতো। কিন্তু ঠিকঠাক দাম পেতেন না। তিনি বলেন, বাজারদর আগে থেকে না জানার কারণে প্রায়ই কম মূল্য পেতেন।
তবে এখন নাইচের ভাষ্য, বাস্তবতা বদলেছে। এখন আর আমাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রির জন্য স্বামীকে হাটে পাঠাতে হয় না। স্মার্টফোনের মাধ্যমে নিজেই পাইকারি ক্রেতাদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করি।


আত্মবিশ্বাসী এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, এখন আমাদের কাছ থেকে অনলাইন মার্কেট প্ল্যাটফর্ম পারমিদা, মার্কেট বাংলা, আবাদ, দারাজ বাংলাদেশ, ফুড ফর নেশনের মতো অন্যান্য কোম্পানি সরাসরি কৃষিপণ্য সংগ্রহ করছে।

 

শুধু নাইচ নন, ই-কমার্সে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন বগুড়ার আদমদিঘীর মাহমুদা আক্তার, ময়মনসিংহের ভালুকার আসমা ইসলাম, বেবী রহমানসহ হাজারো নারী উদ্যোক্তা। তারা বলছেন, করোনাকালে অনলাইনে পণ্য বিক্রির অভ্যাস ও আস্থা তৈরি হয়েছে। তাতে অন্যদেরও স্মার্টফোন, ই-কমার্সে আগ্রহ বাড়ছে। গ্রামের কৃষক ও নারীদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা।


জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকেও দেশব্যাপী উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সেলাই, কম্পিউটার, হাতের কাজসহ বিভিন্ন ট্রেডে নারীদের দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে ই-কমার্সসহ ফ্রিল্যান্সিংয়ে নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।


এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। নারীরা আজ আর ঘরে বসে নেই, তারা এখন সফল উদ্যোক্তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ করেছেন। যেখানে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীরা ই-কমার্স ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন।


সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই সংস্থায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নের মধ্যকাতুলী গ্রামের মাহমুদা আক্তার। তিনি মূলত মুরগি পালনের পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ করেন এবং বেকার তরুণীদের প্রশিক্ষণ দেন। তার খামারে ১ হাজার ৫০০ সোনালি জাতের মুরগি আছে।

 

মাহমুদা বলেন, করোনার শুরুতে প্রায় মুরগি বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তখন ইন্টারনেটে অনলাইনভিত্তিক একটি ই-কমার্স কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে সহযোগিতা করে এবং আমার ফার্মের মুরগি বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আর আমাকে বিক্রি নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি।

 

তিনি যোগ করেন, সেই থেকে নিয়মিত অনলাইনে মুরগি, ডিমসহ হাতের কাজ করা পোশাক-পরিচ্ছদ, নকশিকাঁথাসহ নানা জিনিস বিক্রি করছি। দামও ভালো পাই, বিক্রি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না।

 

ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের নারী উদ্যোক্তা আসমা ইসলাম। সফল সবজি চাষি হিসেবে এরই মধ্যে হবিরবাড়ী এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। চাষের পাশাপাশি ক্ষেতের সবজি অনলাইনে বিক্রির কৌশলও শিখেছেন তিনি।

 

আসমা বলেন, অনলাইনের এত কিছু বুঝি না। করোনায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে বাড়িতে, সারাদিনই ল্যাপটপ আর স্মার্টফোন নিয়ে বসে থাকে। আমার সবজি কম দামে স্থানীয়ভাবে বিক্রি হচ্ছিল। এসময় সে-ই আমাকে অনলাইনে বিক্রি করার বিষয়টি জানায়।

 

ছেলের কাছ থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণে এখন অনলাইন মার্কেটিংয়ে স্মার্টফোন ব্যবহার করে নিজের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করছেন তিনি। এই নারী উদ্যোক্তা জানান, তার উৎপাদিত লাউ, পেঁপে, কপি ঢাকার আগোরা, আবাদ ও দারাজের মতো অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করছেন।

 

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বেবী রহমান জানান, তিনি শুধু হাতের তৈরি নানা পণ্য ও নকশিকাঁথা অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের শুরুর কথা জানিয়ে বলেন, ২০১৬ সালে একশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় ২৫ জন নারী নিয়ে গ্রামে একটি সমিতি করেন। এরপর সমিতির সদস্যরা চাষাবাদের স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। আগে তাদের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় হাটে বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনা শুরু হলে অনলাইন মার্কেট প্লেসে বিক্রি শুরু করেন।


তবে এখনও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন নাইচ। তিনি বলেন, আসলে আমরা গ্রামের মানুষ। প্রযুক্তি বিষয়ে অতোটা জ্ঞান নেই। তবে আমাদের কৃষকদের জন্য এটা একটা সম্ভাবনাময়ী দিক। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনলাইনে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও সহজ করলে বাজার বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামের নারীরা কৃষিপণ্য উৎপাদনে আরও উৎসাহী হবেন। এজন্য সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করেন এই উদ্যোক্তা।

 

এই প্রসঙ্গে ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ এবং ব্র্যান্ডিং করার জন্য জয়িতা ফাউন্ডেশন গঠন করেছে সরকার। রাজধানীর ধানমন্ডিতে মার্চের মধ্যে এই ফাউন্ডেশনের ১০তলা ভবন নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করা হবে।

 

তিনি বলেন, আজ ই-কমার্সে নারীদের জয়জয়কার। দেশে যত অনলাইন ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে, সেটার শতকরা ৮০ ভাগ পরিচালনা করছেন নারীরা। তারা সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

সাকসেস স্টোরি বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর