ঢাকা, ১৯ এপ্রিল শুক্রবার, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৩৩২

সাবান না স্যানিটাইজার, করোনা মারতে কোনটা কার্যকর?

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২০:৫৬ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০  

করোনাভাইরাস মহামারি আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর লকডাউনে আমরা প্রতিনিয়ত শুনেছি-মাস্ক পরুন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। কিন্তু প্রথম দিকে সবচেয়ে জোর দেয়া হয়েছিল কোভিড-১৯ জীবাণু নিধনে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ওপর। আমরা কি সেই পরামর্শের কথা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি?

হাত ধোয়াটা মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। হাত নোংরা হলে আমরা ধুই। প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সময় অভ্যাসের বশে হাত ধুই। কিন্তু গত ছয় মাসে হাত ধোয়া আমাদের জীবনে মরাবাঁচার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।

করোনার বিরুদ্ধে যেসব অস্ত্র নিয়ে আমরা লড়তে নেমেছিলাম-যেমন মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, নিজেকে আলাদা রাখা বা সেলফ আইসোলেশন-এসবের ভিড়ে যে সহজ অস্ত্রটির কথা সহজেই আমরা ভুলে যেতে বসেছি, সেটি হলো হাত ধোয়া।

ফেব্রুয়ারিতে যখন বিশ্বব্যাপী জরুরিকালীন স্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নেয়, তখন স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো তড়িঘড়ি মানুষকে পরামর্শ দেয় প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে বাঁচতে আমাদের কী করতে হবে।
একটা পরামর্শ যা দিনের পর দিন প্রতিদিন আমরা শুনেছি, পড়েছি, দেখেছি-সংবাদ বুলেটিনে, খবরের কাগজের পাতায়, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকারে-সেটা ছিল সাবান এবং গরম পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে হাত ধুতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কীভাবে ঠিকমতো হাত ধুতে হবে, সেটার যেসব গ্রাফিক্স চিত্র প্রকাশ করেছিলে, তা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই চিত্র আমরা মহামারির শুরুর দিকে দেখেছি সর্বত্র- রেস্তোরাঁয়, পানশালায় সবখানেই জনসাধারণের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে।

হাত ধোয়া কি হারিয়ে যাওয়া পরামর্শ?

করোনা মহামারি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর ছয় মাস পার হয়েছে। কোথায় সংক্রমণ এখনও শীর্ষে, কোথায় কমছে বা কমে আবার বাড়ছে, কোথায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন জারি হচ্ছে বা সংক্রমণ ঠেকাতে কোথায় কারফিউ দিতে হবে-এসব নিয়ে নানা বিভ্রান্তির মধ্যে হাত ধোয়ার বিষয়টি এখন কিছুটা গৌণ হয়ে পড়েছে।

লকডাউন যত শিথিল হচ্ছে, যত সবকিছু খোলা হচ্ছে, তত ফেস মাস্ক পরা বা মুখ ঢাকা রাখার গুরুত্বটা বেশি করে সামনে আসছে। কোথায়, কখন, কীভাবে মাস্ক পরা হবে-এটাই এখন আলোচনার কেন্দ্রে। ফলে এ মারণঘাতী ভাইরাস ঠেকানোর আদি মূলমন্ত্র এখন কি অন্য পরামর্শের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে?

ইথিওপিয়ায় একটি জরিপে সম্প্রতি দেখা গেছে, হাসপাতালে যাওয়া এক হাজারের ওপর মানুষের মধ্যে ১ শতাংশেরও কম সঠিকভাবে হাত ধুচ্ছে। তাহলে কি পরামর্শ বদলে গেছে?
মোটেই না- বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। কারণ, মানুষ এখন আগের মতো ঘরবন্দি নেই। অনেক মানুষ বেরুতে শুরু করেছে। ফলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসের চলাচলও বেড়েছে।

আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বস্টনে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রসায়ন ও জৈব রসায়নের অধ্যাপক টমাস গিলবার্ট বলছেন. করোনার যে রাসায়নিক গঠন তাকে ভাঙতে সবচেয়ে কার্যকর সস্তা সাবান এবং গরম পানি। এ ভাইরাসের বাইরে যে আবরণ থাকে, যেটি জীবাণুর জেনেটিক কণাগুলোকে ঘিরে রাখে, সেটাকে বলা হয় লিপিড মেমব্রেন। এ আবরণটা তৈলাক্ত ধরনের।
এটাকেই সাবান আর পানি গলিয়ে দেয়।

তিনি বলছেন, ভাইরাসের কোষগুলোকে ‘খাম’-এর মতো ঘিরে রাখে যে আবরণ, সেটা ভেঙে দিতে পারলে জীবাণুর কোষগুলো আর একজোটে থাকতে পারে না। সেগুলো ভেঙে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে এর জিনের উপাদানগুলো কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ জিনগত উপাদানই মানুষের দেহকোষকে আক্রমণ করে থাকে। কোষের মধ্যে বংশ বৃদ্ধি করে ছড়াতে থাকে। ফলে ওই আবরণটা নষ্ট করতে পারলে ভাইরাসকে অক্ষম করে দেয়া সম্ভব। হাত ধোয়ার সময় কম করার ব্যাপারে কোনোরকম পরামর্শ এখনও দেয়া হয়নি।

গিলবার্ট বলছেন, কাজেই হাত ভিজিয়ে নিয়ে সাবান মাখিয়ে দু’ হাতে ভালো করে ফেনা তৈরি করতে হবে। এরপর ২০ সেকেন্ড ধরে সেই সাবান দিয়ে হাতের প্রতিটা অংশ ভালো করে ডলে ধুতে হবে। প্রতিটা খাঁজ, ভাঁজ নখের চারপাশ সব অংশ সাবানের ফেনা দিয়ে ঘষে ধুতে হবে।

তিনি বলছেন, তৈলাক্ত আবরণকে ভাঙার জন্য যে রাসায়নিক ক্রিয়ার প্রয়োজন তা সম্পন্ন হতে ২০ সেকেন্ড সময় লাগে। জীবাণুর শেষ অংশটুকু হাত থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য সাবানকে কাজ করতে এ সময় দিতে হবে। অল্প গরম পানি এ সাবান ধুয়ে ফেলতে কাজ করবে।

সাবান ব্যবহার জরুরি

ব্রিটেনে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্টিন মিকেলিস বলছেন, শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাস ধ্বংস করা যাবে না। ধরুন আপনি রান্না করছেন, আপনার হাতে বা আঙুলে তেল লেগে আছে। শুধু পানি ব্যবহার করলে কি সেই তেল যাবে? যাবে না। সেজন্য দরকার সাবান। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই। সেটার তৈলাক্ত আবরণ ভেঙে দিতে চাই সাবান। তবেই এ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে।

সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার কার্যকারিতার বিষয়টা কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার কারণে। হাত জীবাণুমুক্ত করার এ রাসায়নিক ছোট বোতলে করে এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া সহজ। দোকানে বাজারে যেকোনো জায়গায় এর ব্যবহার অনেক সুবিধাজনক। তাই মানুষ এ স্যানিটাইজারের দিকে বেশি ঝুঁকছে।

গিলবার্ট বলছেন, আপনি যদি সারাদিন বাসার ভেতরে থাকেন। আপনার ঘরে যদি বাইরের লোক না আসা যাওয়া করে, তাহলে অবশ্যই আপনার বারবার হাতে ধোয়ার প্রয়োজন হবে না। এ ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার হয়তো আপনি গাড়িতে রাখতে পারেন বা আপনার ঘরে ঢোকার দরোজার মুখে রাখলেন অথবা ব্যাগে বা পকেটে রাখলেন, যেখানে সাবান বা পানি পাওয়া যাবে না সেখানে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু যেখানে সাবান আর পানি আছে, সেখানে সাবান আর পানির ব্যবহারই সবচেয়ে ভালো বলে আমি মনে করি।

কত ঘন ঘন হাত ধোয়া উচিত?

মহামারি শুরুর সময় প্রথমদিকে ব্রিটেনের সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারা পরামর্শ দিয়েছিলেন কয়েক ঘণ্টা পর পর হাত ধুতে। যদিও সেসময় বেশিরভাগ মানুষই লকডাউনের কারণে ঘরের ভেতরেই থাকছিল। 

গিলবার্ট বলছেন, মূলত ঘরের ভেতর থাকেন, তাদের এত ঘন ঘন হাত ধোয়ার প্রয়োজন নেই। তবে টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবার তৈরির আগে ও খেতে বসার আগে অবশ্যই সবার হাত ধোয়া উচিত। কেউ যদি কোভিড-১৯ এ কিংবা অন্য যেকোনো ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সেবা বা পরিচর্যা করেন, তাহলে তাদের ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে যদি তারা আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা কোনো জিনিস ধরেন অথবা এমন কোনো জিনিসের ওপর আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিয়েছেন, যেটা তিনি হাত দিয়ে ধরেছেন; তাহলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে হাত ধোয়া দরকার।

জার্মানির বিখ্যাত গবেষক থি মুই ফাম নিজের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, গবেষণায় তিনি দেখেছেন আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা কোনো জিনিস যদি কেউ ধরে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলা অনেক বেশি কার্যকর হয়। সেক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পর হাত ধুলে তা অতটা কার্যকর নাও হতে পারে।

সাবান বনাম অ্যান্টি ভাইরাল হ্যান্ডওয়াশ

অনেকে মনে করেন, ব্যবহারের সুবিধার কারণে নয়, সাধারণ সাবানের থেকে অ্যান্টি-ভাইরাল হ্যান্ডওয়াশ বেশি কার্যকর। কিন্তু অধ্যাপক মিকেলিস বলছেন, সেটা সঠিক নয়। এসবের আসলে কোনো দরকার নেই। 

তিনি বলছেন, অনেকে সাধারণ সাবানের বদলে জীবাণুনাশক বা অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। এসব খুব বেশি ব্যবহারের আবার অন্য ঝুঁকি রয়েছে। খুব বেশিদিন এসব জীবাণুনাশক ব্যবহার করলে বর্জ্য পানিতে এটি জমা হয় এবং অনেক জীবাণু-এসব রাসায়নিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন এসব জীবাণুনাশক আর কাজ করে না। দীর্ঘ মেয়াদে এগুলোর ব্যবহার পরিবেশেরও ক্ষতি করে।

অধ্যাপক গিলবার্ট ও মিকেলিস দুজনেই বলছেন, নির্ভরযোগ্য মানের পানি থাকলে সাবান পানিতে হাত ধোয়াই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে ভালো অস্ত্র। তবে পৃথিবীর অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত অনেক দেশে মোটামুটি বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। অনেক জায়গায় পানিই দুষ্প্রাপ্য। 
চলতি মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি রিপোর্টে বলেছে, করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আগেও বিশ্বে প্রতি পাঁচটির মধ্যে দুটি স্কুলে হাত ধোয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল না। তবে করোনা ঠেকাতে হাত ধোয়ার পানি খাবার পানির মতো বিশুদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
 
তারা বলছেন, হাতের কাছে সাবান বা সাবান জাতীয় কিছু থাকলেই কাজ হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু করোনা নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্য আরও রোগ জীবাণু ঠেকাতে হাত ধোয়া একটা ভালো অভ্যাস। এ ভাইরাস ঠেকাতে যেভাবে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, একইভাবে এ অভ্যাস যদি আমরা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ করে নিতে পারি, তাহলে অনেক সংক্রামক রোগ ঠেকানো সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, শীত মৌসুমে সর্দিজ্বর বা ফ্লু ছড়ায়। তখনও যদি হাত ধোয়ার অভ্যাস আমরা বজায় রাখতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের রোগ ঠেকানোর একটা সুযোগ করে দেবে।