ঢাকা, ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
good-food
৪৫০

কে কাছের, কে দূরের? এটা বুঝেই গলার স্বর বদলে দেয় ব্রেন!

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১৫:৪৩ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

গবেষণাগারে অধ্যাপক ভীষ্মদেব চক্রবর্তী।  ইনসেটে : সহ-গবেষক সুমতী।

গবেষণাগারে অধ্যাপক ভীষ্মদেব চক্রবর্তী। ইনসেটে : সহ-গবেষক সুমতী।

শেখাতে হয় না। চেনাতে হয় না। বোঝাতেও হয় না। আমাদের মস্তিষ্ক (ব্রেন) আপনাআপনিই চিনে নিতে পারে - কে আপন, কে পর! কে কাছের আর কেই বা দূরের। 


অবাক করা ব্যাপার! সেই মতোই ব্রেন আমাদের গলার স্বরটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেয়। কখনও বাঁধে একই তারে। কখনও বা নানা তারে। আমরা জানতেই পারি না!

 

তাই দু’দিন হল ‘জয়েন’ করেছেন যে মহিলা সহকর্মী, তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় না জেনেশুনেই আমার, আপনার গলার স্বরটা বদলে যায়। আবার কোনও মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা থেকে নতুন প্ল্যানে যাওয়ার জন্য ফোনটা যিনি করেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলি একেবারেই অন্য স্বরে। গলার সেই দু’টো স্বরও বদলে যায়, যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে যে জন্মাবধি চিনি। অতটা চিনি না যে মহিলা সহকর্মীকে। মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা থেকে যিনি ফোনটা করেন, তিনি আবার একেবারেই অচেনা।


লোক চিনে-বুঝে ব্রেনের কেরামতিতেই যে আমাদের গলার স্বর বদলে যায় নানাভাবে, আমাদের অজান্তে, তিনটি দেশে পরীক্ষা চালিয়ে তা প্রমাণ করে দিলেন ভারতের বেহালার ভীষ্মদেব। ব্রিটেনের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ‘সেন্টার ফর অটিজম’-এর অধিকর্তা ভীষ্মদেব চক্রবর্তী। এই প্রথম। গবেষকদলে রয়েছেন আর এক বাঙালি। নন্দিনী সিংহ চট্টোপাধ্যায়। দিল্লির ‘সেন্টার ফর ব্রেন সায়েন্স’-এর অধ্যাপক। 


গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সায়কিয়াট্রি’-তে। এই সপ্তাহেই।


ব্রেন সব জানে, আমাদের তা বুঝতে দেয় না !

 

পরীক্ষা চালিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, আমাদের ব্রেনকে বলে দিতে হয় না, কাকে চিনি আর কাকে চিনি না। ব্রেন বুঝে নেয়, কে আমার আপনজন বা কাছের। আর কেই বা দূরের, কতটা দূরের।

 

তাঁরা দেখেছেন, সেই সব বুঝে ব্রেন আমাদের গলার স্বরটাকে নানা ভাবে বদলে দেয়। আমরা বুঝতেও পারি না। দর্শনের এক নামজাদা অধ্যাপকের পরিবারের সন্তান ভীষ্মদেবের পরীক্ষাতেই প্রথম ধরা পড়ল আমাদের ব্রেনের এই চাঞ্চল্যকর 'দর্শন'!

 

আপনি বাংলা, হিন্দি, তামিল, গুজরাতি বা ইংরেজি অথবা ইতালিয়, যে ভাষাতেই কথা বলুন, যে দেশেই থাকুন, গড়ে উঠুন, বেড়ে উঠুন যে কোনও সংস্কৃতিতেই, ব্রেন তার এই কাজটা একইভাবে করে সব ক্ষেত্রেই। আমাদের ভাষা বদলে গেলে, সংস্কৃতি বদলে গেলে, দেশ বদলে গেলেও এ ব্যাপারে ব্রেনের খেয়াল বদলায় না মোটেও। ব্রেন চলে তার নিজের খেয়ালেই।

 

ফলে, আপনি যে দু’জনকে একেবারেই চেনেন না, কিছুটা দূরত্ব থেকে তাঁদের আলাপচারিতা শুনেও বুঝে ফেলতে পারেন ওই দু’জন নিজেদের আগে থেকে চিনতেন নাকি চিনতেন না। চিনলেও কতটা চিনতেন।

 

গবেষণা চালানো হয়েছে ইতালি, ব্রিটেন ও ভারতে

 

মূল গবেষক, বেহালার বেচারাম চ্যাটার্জি রোডের আদত বাসিন্দা ভীষ্মদেব লন্ডন থেকে জানালেন, তিনটি দেশে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। ইতালি, ব্রিটেন আর ভারতে। ১৬০ জন পুরুষ ও নারীর ওপর। যাঁদের ওপর চালানো হয়েছে পরীক্ষা, তাঁদের সকলেরই বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। দু’জন করে বেছে নিয়ে এক একটা ‘জোড়া’ (‘ডায়াড’) বানানো হয়েছে। সেসব জোড়া বানানোর আগে গবেষকরা দেখে নিয়েছেন জোড়ার দু’জন একে অন্যকে চেনেন কি না। চিনলে কতটা চেনেন? বা কত দিন ধরে চেনেন? দ্বিতীয় জন সম্পর্কে যে প্রথম জনের কাছ থেকে খবরাখবর নেওয়া হচ্ছে, তা জোড়ার দ্বিতীয় জনকে জানতে দেওয়া হয়নি। 


আবার দ্বিতীয় জনের কাছ থেকে খবরাখবর নেওয়ার কথাও জানানো হয়নি প্রথম জনকে ভীষ্মদেবের কথায়, “এতেও কিছু মজার তথ্য মিলেছে। দেখা গিয়েছে, জোড়ার এক জন হয়তো ভেবেছেন দ্বিতীয় জন তাঁকে ভালই চেনেন, মনেও রেখেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় জন বলেছেন, প্রথম জনকে তিনি চেনেন না বা মনে রাখেননি।’’

 

জোড়াগুলি বানানো হয়েছে কীভাবে?

 

জোড়া বানানোর সময় আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখেছিলেন গবেষকরা।


প্রথমত, নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন আকর্ষণ স্বাভাবিক বলে তাঁরা কথা বলাবলির জন্য যে জোড়াগুলি বেছেছেন, তাতে রেখেছেন দুই নারী বা দু’জন পুরুষ। কখনওই নারী ও পুরুষকে একটি জোড়ায় রাখেননি। তাতে স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণের ফলে গলার স্বরের তারতম্যের সম্ভাবনাকে এড়ানো গিয়েছে।

 

দ্বিতীয়ত, বয়ঃসন্ধির সময় আমাদের গলা ভাঙে বলে ওই বয়সের কারও ওপর পরীক্ষা চালানো হয়নি। তাই ১৮ বছরের কম বয়সী কাউকে পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অসুস্থতায়, ওষুধের প্রয়োগে বা মেনোপজের পর মহিলাদের গলার স্বর অন্য রকম হয় বলে, ওই বয়সীদের ওপরেও চালানো হয়নি পরীক্ষা।

 

ভীষ্মদেব বলছেন, “জোড়াগুলির দু’জনের মধ্যে কথা বলাবলিটা আমরা রেকর্ড করেছি আড়াই / তিন মিনিট থেকে ৬ মিনিট পর্যন্ত।’’

 

জোড়াগুলির দু’জনের কথা বলাবলি হয়েছে কীসের ভিত্তিতে?

 

ভীষ্মদেব বলছেন, “আমরা প্রতিটি জোড়ার দু’জনকে পিকাসোর আঁকা দু’টি ছবি দিয়েছিলাম। প্রথমজনকে বলেছিলাম, তাঁর হাতে থাকা ছবিটা কী বলতে চাইছে, তা দ্বিতীয় জনকে বোঝান। একই ভাবে দ্বিতীয় জনকেও বলেছিলাম তাঁর কাছে থাকা পিকাসোর ছবিটার মর্মার্থ প্রথম জনকে বুঝিয়ে বলুন।’’

 

গবেষকরা জোড়াগুলি বানিয়েছিলেন নানা ভাবে। কোথাও রেখেছিলেন একে অন্যকে একেবারেই চেনেন না এমন দু’জনকে। আবার দু’জনই একে অন্যকে খুব ভাবে চেনেন, এমন জোড়াও বানানো হয়েছিল। কোনও কোনও জোড়ায় রাখা হয়েছিল এমন দু’জনকে যাঁরা একে অন্যকে খুব অল্প চেনেন।

 

কী দেখলেন গবেষকরা?

 

ভীষ্মদেব জানাচ্ছেন, যে জোড়ার দু’জন নিজেদের একেবারেই চেনেন না, দেখা গিয়েছে, তাঁরা একে অন্যকে পিকাসোর আঁকা ছবিদু’টি বোঝাচ্ছেন একঘেয়ে স্বরে। সেই স্বরে কোনও ওঠা-নামা নেই। নেই কম্পাঙ্কের (ফ্রিকোয়েন্সি) বিভিন্নতা। মোটামুটি একই কম্পাঙ্ক থাকে তাঁদের কথা বলাবলির সময়।

 

আর যে জোড়ার দু’জন একে অন্যকে খুব ভাল চেনেন, ছবি বোঝানোর সময় তাঁদের গলার স্বর খুব ওঠা-নামা করে। তাঁদের গলার স্বরে বিভিন্ন কম্পাঙ্ক থাকে। যে জোড়ার দু’জন একে অন্যের কাছে একেবারে অচেনা না হলেও অল্প চেনা-জানা আছে, তাঁদের কথা বলাবলির সময়েও গলার স্বর একঘেয়ে হয় না। সেখানেও ওঠা-নামা থাকে। তবে সেই ওঠা-নামা অনেক কম। সেই স্বরে কম্পাঙ্কের বিভিন্নতা তুলনায় কম থাকে বলে।

 

কম্পাঙ্কের বিভিন্নতা মাপা হয় কীভাবে?

 

গবেষকরা জানাচ্ছেন, যে পদ্ধতিতে সেটা মাপা হয়, স্নায়ুবিজ্ঞানের (নিউরোসায়েন্স) পরিভাষায় তার নাম - ‘আর্টিকুলেশন স্পেস ম্যাপিং’। 


আমাদের গলার স্বরের কম্পাঙ্কের ওঠা-নামাটা ধরা পড়ে সেই আর্টিকুলেশন স্পেসের চেহারায়। দু’জন একে অন্যকে বেশি দিন ধরে চিনলে তাঁদের আলাপচারিতায় যে আর্টিকুলেশন স্পেসের জন্ম হয়, সেটা বেশ চওড়া। আর একে অন্যকে আদৌ না চিনলে সেই স্পেসটা হয় সরু। অল্প চিনলে ততটা সরু হয় না। আবার ততটা চওড়াও হয় না।

 

কারও ‘অটিস্টিক’ বৈশিষ্ট থাকলে কী হয়?

 

অটিস্টিক বৈশিষ্ট আমাদের সকলেরই থাকে। কারও কম, কারও বেশি। যাঁদের সেই বৈশিষ্ট (অটিজম) অনেক বেশি, তাঁদের কোনও কোনও ক্ষেত্রে অটিজমের 'ডায়াগনসিস' করানোর দরকার হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে বলা হয়, ‘অটিস্টিক এবিলিটিজ’ বা ‘অটিস্টিক ট্রেট্স’।

 

গবেষকরা এটাও দেখেছেন, সেই অটিস্টিক বৈশিষ্টগুলি যাঁদের যত বেশি, তাঁরা মানুষের সঙ্গে কথা বললে সেই স্বরে তুলনামূলক ভাবে এক ধরনের একঘেয়েমি থাকে। সেই স্বরে কম্পাঙ্কের বিভিন্নতা থাকে না বললেই চলে। তাই থাকে না স্বরের ওঠা-নামা। তা সেই অটিস্টিক বৈশিষ্ট থাকা কারও সঙ্গে যতই পরিচিতি থাকুক অন্য কারও।

“সেখানে চেনা বা অচেনায় তেমন কিছুই যায় আসে না”, বলছেন ভীষ্মদেব। 


অটিস্টিক বৈশিষ্ট থাকা মানুষ তাঁর চেনা-জানাদের সঙ্গে যে স্বরে কথা বলেন (একঘেয়ে), সেই একই স্বরে তাঁরা কথা বলেন অচেনাদের সঙ্গেও।

 

আমাদের ব্রেন সেই সব ক্ষেত্রে চেনা, অচেনা বাছবিচারের সহজাত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কি না, তা এই গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল না। তবে তাঁদের গবেষণার এই পর্যবেক্ষণ এ ব্যাপারে আগামী দিনে গবেষণার দরজাটা খুলে দিতে পারে।

 

এই গবেষণার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে কি?

 

ভীষ্মদেব মেনে নিচ্ছেন, তিনটি দেশের মানুষের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হলেও, যে ভাষা সুরে সুরে বলা হয় (যাকে বলা হয়, ‘টোনাল ল্যাঙ্গুয়েজেস’), তেমন কোনও ভাষায় কথা বলা কোনও জনগোষ্ঠীর ওপর এই গবেষণা হয়নি।

 

“আমরা কাজটা করেছি, মূলত ‘নন-টোনাল ল্যাঙ্গুয়েজেস’ নিয়ে। টোনাল ল্যাঙ্গুয়েজে গলার স্বরে কম্পাঙ্কের বিভিন্নতা বেশি থাকবে, এটাই আশা করা যায়। যেমন, কয়েকটি উপজাতি বা জনগোষ্ঠীর ভাষা। বা কয়েকটি সুপ্রাচীন ভাষা। যখন সুরে সুরেই অনেক কথা বোঝানো হত। তাই সুরের বিভিন্নতার প্রয়োজন হত কথা বলার সময়”, বলছেন ভীষ্মদেব।

 

গবেষণা কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে?

 

অন্যতম গবেষক নন্দিনী সিংহ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, অন্তত তিনটি দিক রয়েছে, যে পথে এই গবেষণাকে আগামী দিনে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

 

প্রথমত, আরও বেশি সংখ্যক দেশে, আরও বেশি সংখ্যায় বিভিন্ন ভাষাভাষি ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে এই পরীক্ষাটা চালানোর দরকার। টোনাল ল্যাঙ্গুয়েজ-গুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করার দরকার আছে পরবর্তী পর্যায়ের গবেষণায়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতেও আলাপচারিতার ভাষা, গলার স্বর বদলে যেতে পারে হয়তো বা। সেটাও দেখতে হবে।

 

দ্বিতীয়ত, অটিস্টিক বৈশিষ্ট রয়েছে যাঁদের, তাঁরা কীভাবে সামাজিকভাবে মেশেন, তাঁর সমাজের সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেন, গবেষণার পরবর্তী ধাপে সেই দিকগুলিও খতিয়ে দেখার দরকার রয়েছে।

 

তৃতীয়ত, পরীক্ষার জন্য বানানো জোড়াগুলিতে নারী ও পুরুষকেও একইসঙ্গে রেখে দেখতে হবে বয়ঃসন্ধির পর বা বার্ধক্যে পৌঁছলে তাঁদের আলাপচারিতাতেও গলার স্বরের এই তারতম্য কতটা বদলে যায়, বা তা আদৌ বদলায় কি না। দেখতে হবে, সমকামী বা উভলিঙ্গদের ক্ষেত্রে কী হয়।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভীষ্মদেব, নন্দিনীদের এই গবেষণা আগামী দিনে অনেক সম্ভাবনাময় গবেষণার রাস্তা খুলে দিতে পারে। যা অটিস্টিক ছেলেমেয়ে ও তাঁদের পরিবারকেও সাহায্য করতে পারে ভবিষ্যতে। সূত্র : আনন্দবাজার।